ইন্দু ও কমল
নিবারণের বাসা
ইন্দু ও কমল
কমল।
না ভাই ইন্দু,ওরকম করে তুই বলিস নে।
ইন্দু।
কিরকম করে বলতে হবে? বলতে হবে,স্ত্রীর ভরটুকুও সইতে পারেন না,বিনোদবিহারী এত বড়োই শৌখিন কবি! তাঁর বড়োজোর সহ্য হয় ফিকে চাঁদের আলো,কিম্বা ঝরা ফুলের গন্ধ। আমি ভাবছি তোর মতো মেয়েকেও সইতে পারল না ওর রুচিটি এতই ফিন্ফিনে,আর তুই যে ওর মতো পুরুষকেও সহ্য করতে পারছিস তোর রুচিকে বাহাদুরি দিই।
কমল।
তুই বুঝিস নে ইন্দু,ওরা যে পুরুষমানুষ। আমাদের এক ভাব, ওদের আর-এক ভাব। মেয়েমানুষের ভালোবাসা সবুর করতে পারে না, বিধাতা তার হাতে সে অবসর দেন নি। পুরুষ অনেক ঠেকে,অনেক ঘা খেয়ে,তার পরে ভালোবাসতে শেখে; ততদিনে পৃথিবী সবুর করে থাকে,কাজের ব্যাঘাত হয় না।
ইন্দু।
ইস! কী সব নবাব! আচ্ছা দিদি, তুই কি বলিস গদাই গয়্লার সঙ্গে আজই যদি আমার বিয়ে হয় অমনি কাল ভোর থেকেই তাড়াতাড়ি তার চরণদুটো ধরে সেবা করতে বসে যাব--মনে করব,ইনি আমার চিরকালের গয়লা,পূর্বজন্মের গয়লা,বিধাতা একে এবং এর অন্য গোরুগুলোকে গোয়ালসুদ্ধ আমারই হাতে সমর্পণ করে দিয়েছেন।
কমল।
ইন্দু, তুই কী যে বকিস আমি তোর সঙ্গে পেরে উঠি নে। গদাই গয়লাকে তুই বিয়ে করতে যাবি কেন,সে একে গয়লা,তাতে আবার তার দুই বিয়ে।
ইন্দু।
আচ্ছা না-হয় গদাই গয়লা না হল--পৃথিবীতে গদাইচন্দ্রের তো অভাব নেই।
কমল।
তা তোর অদৃষ্টে যদি কোনো গদাই থাকে তা হলে অবিশ্যি তাকে ভালোবাসবি--
ইন্দু।
কক্খনো বাসব না। আচ্ছা,তুমি দেখো। বিয়ে করেছি বলেই যে অমনি তার পরদিন থেকে গদাই গদাই করে গদগদ হয়ে বেড়াব,আমাকে তেমন মেয়ে পাও নি। আমি দিদি, তোর মতন না ভাই!
কমল।
আসল জানিস,ইন্দু? ওদের না হলে আমাদের চলতে পারে,কিন্তু আমাদের না হলে পুরুষমানুষের চলে না,সেইজন্যে ওদের আমরা ভালোবাসি।
নিবারণের প্রবেশ
নিবারণের প্রবেশ
নিবারণ।
মা,তোমাকে দেখলে আমি চোখের জল রাখতে পারি নে। আমার মার কাছে আমি অপরাধী। তোমার কাছে আমার দাঁড়ানো উচিত হয় না।
কমল।
কাকা, আপনি অমন করে বলবেন না,আমার অদৃষ্টে যা ছিল তাই হেয়েছে--
ইন্দু।
বাবা, আসলে যার অপরাধ তাকে কিছু না বলে তার অপরাধ তোমরা পাঁচজনে কেন ভাগ করে নিচ্ছ,আমি তো বুঝতে পারি নে।
নিবারণ।
থাক্ মা,সে-সব আলোচনা থাক্--এখন একটা কাজের কথা বলি। কমল, মন দিয়ে শোনো। তোমাকে এতদিন গরিবের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়ে এসেছি,সে কথাটা ঠিক নয়। তোমার বাপের সম্পত্তি নিতান্ত সামান্য ছিল না, আমারই হাতে সে-সমস্ত আছে। ইতিমধ্যে অনেক টাকা জমেছে এবং সুদেও বেড়েছে; তোমার কুড়ি বছর বয়স হলে তবে তোমার পাবার কথা। সময় হয়েছে,এখন নাও তোমার বিষয়। সেই টানে হয়তো স্বামীও এসে পড়বে।
কমল।
কাকা, তাঁকে আপনি এ সংবাদ দেবেন না। কথাটা যাতে কেউ টের না পায়,আপনাকে তাই করতে হবে।
নিবারণ।
কেন বলো দেখি মা?
কমল।
একটু কারণ আছে। সমস্তটা ভেবে আপনাকে পরে বলব।
নিবারণ।
আচ্ছা।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
ইন্দু।
তোর মতলবটা কী আমাকে বল্ তো।
কমল।
আমি আর-একটা বাড়ি নিয়ে ছদ্মবেশে ওঁর কাছে অন্য স্ত্রীলোক বলে পরিচয় দেব।
ইন্দু।
সে তো বেশ হবে ভাই! ওরা ঠিক নিজের স্ত্রীকে ভালোবেসে সুখ পায় না। কিন্তু বরাবর রাখতে পারবি তো?
কমল।
বরাবর রাখবার ইচ্ছে তো আমার নেই, বোন--
ইন্দু।
ফের আবার একদিন স্বামী-স্ত্রী সাজতে হবে নাকি?
কমল।
হাঁ,ভাই,যতদিন যবনিকাপতন না হয়। ঐ শিবচরণবাবু বোধ হয় আসছেন,চলো পালাই।
[ উভয়ের প্রস্থান
[ উভয়ের প্রস্থান
গদাই ও শিবচরণের প্রবেশ
গদাই ও শিবচরণের প্রবেশ
শিবচরণ।
দেখ্,নিবারণকে আজ শেষ কথা বলব বলেই এখানে এসেছি। এখন তোর মনের কথাটা স্পষ্ট করেই বল্।
গদাই।
আমি তো সব কথা স্পষ্ট করেই বলেছি। বিয়ে করবার কথায় এখন মন দিতেই পারছি নে।
শিবচরণ।
এই বুড়ো বয়সে তুই যে একটা সামান্য বিষয়ে আমাকে এত দুঃখ দিবি,তা কে জানত!
গদাই।
বাবা,এটা কি সামান্য বিষয় হল!
শিবচরণ।
আরে বাপু,সামান্য না তো কী? বিয়ে করা বৈ তো নয়! রাস্তায় মুটে-মজুরগুলোও যে বিয়ে করছে। ওতে তো খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না,বরঞ্চ কিছু টাকা খরচ আছে,তা সেও বাপ-মায়ে জোগায়। তুই এমন বুদ্ধিমান ছেলে, এতগুলো পাস করে শেষকালে এইখানে এসে ঠেকল!
গদাই।
আপনি তো সব শুনেছেন,আমি তো বিয়ে করতে অসম্মত নই--
শিবচরণ।
আরে,তাতেই তো আমার বুঝতে আরো গোল বেধেছে। যদি বিয়ে করতেই আপত্তি না থাকে,তবে না-হয় একটাকে না করে আর-একটাকেই করলি। নিবারণকে কথা দিয়েছি,আমি তার কাছে মুখ দেখাই কী করে?
গদাই।
নিবারণবাবুকে ভালো করে বুঝিয়ে বললেই সব--
শিবচরণ।
আরে,আমি নিজে বুঝতে পারি নে; নিবারণকে বোঝাব কী? আমি যদি তোর মাকে বিয়ে না ক'রে তোর মাসিকে বিয়ে করবার প্রস্তাব মুখে আনতুম,তা হলে তোর ঠাকুরদাদা কি আমার দুখানা হাড় একত্র রাখত? পড়েছিস ভালো মানুষের হাতে--
গদাই।
শুনেছি,আমার ঠাকুরদামশায়ের মেজাজ ভালো ছিল না--
শিবচরণ।
কী বলিস বেটা! মেজাজ ভালো ছিল না! তোর বাবার চেয়ে তিনশো গুণে ভালো ছিল। কিছু বলি নে ব'লে, বটে! সে যা হোক, এখন যা হয় একটা কথা ঠিক্ করেই বল্।
গদাই।
আমি তো বরাবর এক কথাই বলে আসছি।
শিবচরণ।
(সরোষে) তুই তো বলছিস এক কথা! আমি কি এক কথার বেশি বলছি? মাঝের থেকে কথা যে আপনিই দুটো হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন নিবারণকে বলি কী! তা সে যাই হোক, তুই তা হলে নিবারণের মেয়ে ইন্দুমতীকে কিছুতেই বিয়ে করবি নে? যা বলবি এক কথা বল্।
গদাই।
কিছুতেই না,বাবা।
শিবচরণ।
একমাত্র বাগবাজারের কাদম্বিনীকেই বিয়ে করবি? ঠিক করে বলিস। এক কথা!
গদাই।
সেরকমই স্থির করেছি--
শিবচরণ।
বড়ো উত্তম কাজ করেছ--এখন আমি নিবারণকে কী বলব?
গদাই।
বলবেন,আপনার অবাধ্য ছেলে তাঁর কন্যা ইন্দুমতীর যোগ্য নয়।
শিবচরণ।
কোথাকার নির্লজ্জ! আমাকে আর তোর শেখাতে হবে না। কী বলতে হবে তা আমি বিলক্ষণ জানি। তবে ওর আর কিছুতেই নড়চড় হবে না? এক কথা--
গদাই।
না বাবা, সেজন্যে আপনি ভাববেন না।
শিবচরণ।
আরে মলো! আমি সেইজন্যেই ভেবে মরছি আর-কী! আমি ভাবছি নিবারণকে বলি কী।