লোকারণ্য। শঙ্খ। হুলুধ্বনি। সানাই
নিবারণ ও শিবচরণ
বাসরঘরের বাহিরে
লোকারণ্য। শঙ্খ। হুলুধ্বনি। সানাই
নিবারণ ও শিবচরণ
নিবারণ।
কানাই! ও কানাই! কী করি বলো দেখি! কানাই গেল কোথায়?
শিবচরণ।
তুমি ব্যস্ত হোয়ো না ভাই! এ ব্যস্ত হবার কাজ নয়। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি। তুমি পাত পাড়া হল কি না দেখে এসো দেখি।
ভৃত্য।
বাবু,আসন এসে পৌঁচেছে,সেগুলো রাখি কোথায়?
নিবারণ।
এসেছে! বাঁচা গেছে। তা সেগুলো ছাতে--
শিবচরণ।
ব্যস্ত হচ্ছ কেন দাদা! কী হয়েছে বলো দেখি। কী রে বেটা,তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? কাজকর্ম কিছু হাতে নেই নাকি?
ভৃত্য।
আসন এসেছে,সেগুলো রাখি কোথায় তাই জিজ্ঞাসা করছি।
শিবচরণ।
আমার মাথায়! একটু গুছিয়েগাছিয়ে নিজের বুদ্ধিতে কাজ করা,তা তোদের দ্বারা হবে না। চল্,আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। ওরে বাতিগুলো যে এখনো জ্বালালে না। এখানে কোনো কাজেরই একটা বিলিব্যবস্থা নেই--সমস্ত বেবন্দোবস্ত। নিবারণ,ভই,তুমি একটু ঠান্ডা হয়ে বোসো দেখি--ব্যস্ত হয়ে বেড়ালে কোনো কাজই হয় না। আঃ,বেটাদের কেবল ফাঁকি! বেহারা বেটারা সব পালিয়েছে দেখছি,আচ্ছা করে তাদের কানমলা না দিলে--
নিবারণ।
পালিয়েছে নাকি! কী করা যায়?
শিবচরণ।
ব্যস্ত হোয়ো না ভাই--সব ঠিক হয়ে যাবে। বড়ো বড়ো ক্রিয়াকর্মের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা ভারি দরকার। কিন্তু এই রেধো বেটার সঙ্গে তো আর পারি নে! আমি তাকে পইপই করে বললুম"তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লুচি ভাজিয়ো',কিন্তু কাল থেকে হতভাগা বেটার চুলের টিকি দেখবার জো নেই! লুচি যেন কিছু কম পড়েছে বোধ হচ্ছে।
নিবারণ।
বলো কী শিবু! তা হলে তো সর্বনাশ!
শিবচরণ।
ভয় কী দাদা! তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, সে আমি করে নিচ্ছি। একবার রাধুর দেখা পেলে হয়,আচ্ছা করে শুনিয়ে দিতে হবে।
চন্দ্রকান্ত বিনোদ প্রভৃতির প্রবেশ
চন্দ্রকান্ত বিনোদ প্রভৃতির প্রবেশ
নিবারণ।
আহার প্রস্তুত চন্দ্রবাবু,কিছু খাবেন চলুন।
চন্দ্রকান্ত।
আমাদের পরে হবে,আগে সকলের হোক।
শিবচরণ।
না না,একে একে সব হয়ে যাক। চলো চন্দর,তোমাদের খাইয়ে আনি গে। নিবারণ, তুমি কিছু ব্যস্ত হোয়ো না,আমি সব ঠিক করে নিচ্ছি। কিন্তু লুচিটা কিছু কম পড়বে বোধ হচ্ছে।
নিবারণ।
তা হলে কী হবে শিবু!
শিবচরণ।
ঐ দেখো! মিছিমিছি ভাব কেন? সে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন কেবল সন্দেশগুলো এসে পৌঁছলে বাঁচি। আমার তো বোধ হচ্ছে,ময়রা বেটা বায়না নিয়ে ফাঁকি দিলে।
নিবারণ।
বলো কী ভাই!
শিবচরণ।
ব্যস্ত হোয়ো না। আমি সব দেখে শুনে নিচ্ছি।
[ শিবচরণ ও নিবারণের প্রস্থান
[ শিবচরণ ও নিবারণের প্রস্থান
চন্দ্রকান্ত।
ওরে বিনু,খাবার লোভে চলেছিস বুঝি?
বিনোদ।
কেন,তোমার লোভ একেবারে নেই নাকি?
চন্দ্রকান্ত।
কাজ আছে যে।
বিনোদ।
কাজ তো ফতে হয়ে গেছে,আবার কী?
চন্দ্রকান্ত।
যে কাজ হয়ে গেছে সে তো ব্যক্তিগত। এখন লড়াই বাকি আছে হিউম্যানিটির জন্যে।
বিনোদ।
বাস্ রে,এই অর্ধেক রাত্তিরে শেষকালে হিউম্যানিটি নিয়ে পড়তে হবে?
চন্দ্রকান্ত।
হিউম্যানিটির জন্যে যত ষড়যন্ত্র সে তো অর্ধেক রাত্তিরেই।
বিনোদ।
কোন্ দুঃসাধ্য কাজ করতে হবে বলো শুনি।
চন্দ্রকান্ত।
বাসরঘরের রুদ্ধ দুর্গ আজ আমরা স্টর্ম্ করব।
বিনোদ।
আমরা ভীরু,সামান্য পুরুষজাত মাত্র--আমাদের দ্বারা কি এত বড়ো বিপ্লব ঘটতে পারবে।
চন্দ্রকান্ত।
নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান কোরো না বিনোদ! ভেবে দেখো, ত্রেতাযুগে যারা সেতুবন্ধন করেছিল জীব হিসাবে তারাও যে আমাদের চেয়ে খুব বেশি শ্রেষ্ঠ ছিল তার প্রমাণ নেই--এমন-কি,এক-আধটা বাহ্য বাহুল্য ছাড়া অনেক বিষয়েই মিল ছিল; মহৎ লক্ষ্য হৃদয়ে রেখে তারাও হেঁটে সমুদ্র পার হল। আর,আমাদের কেবলমাত্র এই দরজাটুকু পার হতে হবে। এতকাল এই বাসরঘরের সামনে স্ত্রীপুরুষের যে বিচ্ছেদসমুদ্র বিরাজ করছে কেবল একটিমাত্র মহাবীর বরবেশে সেটা লঙ্ঘন করবার অধিকারী; কিষ্কিন্ধ্যার বাকি সকলকেই এ পারে পড়ে থাকতে হয়,এই অগৌরব যদি আমরা মোচন করতে না পারি তা হলে ধিক্ আমাদের পৌরুষ!
বিনোদ।
হিয়ার হিয়ার!
চন্দ্রকান্ত।
এতদিন সেখানে কেবল ভুজমৃণালের শাসনই বলবান ছিল। আজ বঙ্গোপসাগরের উত্তর তীর থেকে হিমালয়ের দক্ষিণপ্রান্ত পর্যন্ত সকল পুরুষে এককণ্ঠে বলো দেখি,"নাহি কে বল এ ভুজ-অর্গলে?'
বিনোদ।
আছে আছে!
চন্দ্রকান্ত।
নবযুগে পুরুষদের কারখানাঘর-আপিসঘরের সামনে ফেমিনিজ্ম্এর আক্রমণ চলছে,আজ বাসরঘরের সামনে আমরা ম্যাস্কুলিনিজ্ম্ প্রচার করব। আমরা যুগান্তরের পাইওনিয়ার।
বিনোদ।
জয়,পুরুষজাতিকী জয়!
চন্দ্রকান্ত।
অত্যাচারকারিণীদের সিংহাসন আজ বিচলিত হোক। আবার বলো,জয় পুরুষজাতিকী জয়। গদাই, গদাই, গদাই, গদাধর, ভীরু, ট্রেটর্, এসো তুমি, খোলো রুদ্ধদ্বার, ভাঙো পুরুষজাতির অপমানের বাধা।
বিনোদ।
চন্দরদা,ওকে স্পেশ্যাল্ কন্শেসন্ দিয়ে এরা কিনে নিয়েছে--ডিভাইড অ্যান্ড্ রুল্ পলিসি। ওকে সহজে পাওয়া যাবে না।
চন্দ্রকান্ত।
সে কিছুতেই হচ্ছে না। আজ অসম্মানিত পুরুষজাতির আহ্বান তার মুগ্ধ হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছবেই। গদাই! গদাধর! বিশ্বাসঘাতক! স্বজাতিবিদ্রোহী কাপুরুষ।
গদাই, ইন্দু ও কমলের প্রবেশ
গদাই, ইন্দু ও কমলের প্রবেশ
কমল।
এখানে দাঁড়িয়ে আপনারা করছেন কী?
চন্দ্রকান্ত।
সিডিশন্।
ইন্দু।
আপনাদের সাহস তো কম নয়!
চন্দ্রকান্ত।
শর্ট্হ্যান্ড্-লিখিয়ে রিপোর্টার কেউ উপস্থিত ছিল না,তাই ভাষাটা হয়তো কিছু অসংযত হয়েছিল। আর কিছুই নয়, আমরা বলছিলুম,"ভাগ্যদেবীগণ,রুদ্ধদ্বার খোলো--পাপীদের ক্ষমা করবার প্রত্যক্ষ আনন্দটা ভোগ করে নাও,তাতে স্বর্গেরও গৌরব,মর্তেরও পরিত্রাণ।'
ইন্দু।
যারা ক্ষমা করবার যোগ্য তাদের তো ক্ষমা হয়ে গেছে।
চন্দ্রকান্ত।
এতবড়ো নিষ্ঠুর কথাটা বলতে পারলেন দয়াময়ী? দেবী, আমিই কি পাপিষ্ঠতম? এদের দুজনের চেয়েও অধম?
ইন্দু।
তিনি আপনাকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
চন্দ্রকান্ত।
দেবী,সেটা কি তাঁর পক্ষে আমার চেয়ে কম শোচনীয়? যিনি তারিণী তাঁর জন্যে যদি একটা বাঁধা পাপীর বরাদ্দ না থাকে তবে তো একেবারে বেকার তিনি। যাকে বলে, আন্এম্প্লয়্মেন্ট্ প্রব্লেম্! বড়োবউ,তোমার অনুপস্থিতিতে যদি দৈবাৎ আমার সংশোধন হয়ে যায়,যদি তোমার জন্যে সবুর করতে না পারি,যদি পরিত্রাণের দোসরা পথ জুটে যায়, তা হলে সেটাতে কি তোমারই যশ না আমারই!
ক্ষান্তমণির প্রবেশ
ক্ষান্তমণির প্রবেশ
ক্ষান্তমণি।
আঃ, মিছেমিছি চেঁচাচ্ছ!
চন্দ্রকান্ত।
মিছেমিছি নয় দেবী! পৃথিবীসুদ্ধ লোক চেঁচাচ্ছে পরিত্রাণের দরবারে--কেউ-বা ধর্মে, কেউ-বা কর্মে, কেউ-বা পলিটিক্সে, আর আমিই যদি চুপ করে থাকব তা হলে নিতান্তই ঠকব যে। এই দুটি ভাগ্যবানদের দিকে তাকিয়ে আমি আর থাকতে পারলুম না। একটু চেঁচিয়েছি,ফলও পেয়েছি--এখন যবনিকাপতনের পূর্বে দয়াময়ীদের বন্দনাটা সেরে নিই।
গান। প্রথমে চন্দ্রকান্ত পরে সকলে মিলিয়া
বাউলের সুর
যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে
সেই আমাদের ভালো।
আমাদের এই আঁধার ঘরে
সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালো।
কেউ-বা অতি জ্বলজ্বল,কেউ-বা ম্লান ছলছল--
কেউ-বা কিছু দহন করে,কেউ-বা স্নিগ্ধ আলো।
নূতন প্রেমে নূতন বধূ আগাগোড়া কেবল মধু,
পুরাতন অম্ল-মধুর--একটুকু ঝাঁঝাঁলো।
বাক্য যখন বিদায় করে চক্ষু এসে পায়ে ধরে,
রাগের সঙ্গে অনুরাগে সমান ভাগে ঢালো।
আমরা তৃষ্ণা তোমরা সুধা,
তোমরা তৃপ্তি আমরা ক্ষুধা,
তোমার কথা বলতে কবির কথা ফুরালো।
যে মূর্তি নয়নে জাগে সবই আমার ভালো লাগে--
কেউ-বা দিব্যি গৌরবরন,কেউ-বা দিব্যি কালো।