পুপেদি'কে বললেম, বুদ্ধি তোমার অত্যন্ত পেকে উঠছে, তাই মনে করছি আজ তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেব, একদিন তুমি ছেলেমানুষ ছিলে।
দিদি হেসে উঠে বললে, ঐখানে তোমার জিত। তুমিও এক কালে ছেলেমানুষ ছিলে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেবার উপায় আমার হাতে নেই।
আমি নিশ্বাস ফেলে বললুম, বোধ হয় আজকের দিনে কারও হাতেই নেই। আমিও শিশু ছিলুম, তার একমাত্র সাক্ষী আছে ঐ আকাশের তারা। আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি তোমার একদিনকার ছেলেমানুষির কথা বলব। তোমার ভালো লাগবে কি না জানি নে, আমার মিষ্টি লাগবে।
আচ্ছা, ব'লে যাও।
বোধ হচ্ছে, ফাল্গুন মাস পড়েছে। তার আগেই ক'দিন ধরে রামায়ণের গল্প শুনেছিলে সেই চিক্চিকে-টাক-ওয়ালা কিশোরী চট্টোর কাছে। আমি সকাল বেলায় চা খেতে খবরের কাগজ পড়ছি,তুমি এতখানি চোখ ক'রে এসে উপস্থিত। আমি বললেম, হয়েছে কী।
হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, আমাকে হরণ ক'রে নিয়েছে।
কী সর্বনাশ। কে এমন কাজ করলে।
এ প্রশ্নের উত্তরটা তখনও তোমার মাথায় তৈরি হয় নি। বলতে পারতে রাবণ, কিন্তু কথাটা সত্য হত না ব'লে তোমার সংকোচ ছিল। কেননা, আগের সন্ধেবেলাতেই রাবণ যুদ্ধে মারা গিয়েছে, তার একটা মুণ্ডুও বাকি ছিল না। উপায় না দেখে একটু থম্কে গিয়ে তুমি বললে, সে আমাকে বলতে বারণ করেছে।
তবেই তো বিপদ বাধালে। তোমাকে এখন উদ্ধার করা যায় কী ক'রে। কোন দিক দিয়ে নিয়ে গেল।
সে একটা নতুন দেশ।
খান্দেশ নয় তো?
না।
বুন্দেলখণ্ড নয়?
না।
কী রকমের দেশ।
নদী আছে, পাহাড় আছে, বড়ো বড়ো গাছ আছে। খানিকটা আলো, খানিকটা অন্ধকার।
সে তো অনেক দেশেই আছে। রাক্ষস-গোছের কিছু দেখতে পেয়েছিলে? জিব-বের-করা কাঁটাওয়ালা?
হাঁ হাঁ, সে একবার জিব মেলেই কোথায় মিলিয়ে গেল।
বড়ো তো ফাঁকি দিলে, নইলে ধরতুম তার ঝুঁটি। যাই হোক, একটা কিছুতে করে তো তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল। রথে?
না।
ঘোড়ায়?
না।
হাতিতে?
ফস্ ক'রে ব'লে ফেললে, খরগোষে। ঐ জন্তুটার কথা খুব মনে জাগছে; জন্মদিনে পেয়েছিলে একজোড়া বাবার কাছ থেকে।
আমি বললেম, তবেই তো চোর কে তা জানা গেল।
টিপিটিপি হেসে তুমি বললে, কে বলো তো।
এ নিঃসন্দেহ চাঁদামামার কাজ।
কী ক'রে জানলে।
তারও যে অনেক কালের বাতিক খরগোষ পোষা।
কোথায় পেয়েছিল খরগোষ।
তোমার বাবা দেয় নি।
তবে কে দিয়েছিল।
ও চুরি করেছিল ব্রহ্মার চিড়িয়াখানায় ঢুকে।
ছিঃ।
ছিঃই তো। তাই ওর গায়ে কলঙ্ক লেগেছে, দাগা দিয়েছেন ব্রহ্মা।
বেশ হয়েছে।
কিন্তু শিক্ষা হল কই। আবার তো তোমাকে চুরি করলে। বোধ হয় তোমার হাত দিয়ে ওর খরগোষকে ফুলকপির পাতা খাওয়াবে।
খুশি হলে শুনে। আমার বুদ্ধির পরখ করবার জন্যে বললে, আচ্ছা, বলো দেখি, খরগোষ কী ক'রে আমাকে পিঠে ক'রে নিলে।
নিশ্চয় তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে।
ঘুমলে কি মানুষ হাল্কা হয়ে যায়।
হয় বই কি। তুমি ঘুমিয়ে কখনো ওড় নি?
হাঁ, উড়েছি তো।
তবে আর শক্তটা কী। খরগোষ তো সহজ, ইচ্ছে করলে কোলা ব্যাঙের পিঠে চড়িয়ে তোমাকে মাঠময় ব্যাঙ-দৌড় করিয়ে বেড়াতে পারত।
ব্যাঙ। ছী ছি ছি! শুনলেও গা কেমন করে।
না, ভয় নেই--ব্যাঙের উৎপাত নেই চাঁদের দেশে। একটা কথা জিগেস করি, পথের ব্যাঙ্গমাদাদার সঙ্গে তোমার দেখা হয় নি কি।
হাঁ, হয়েছিল বই কি।
কিরকম।
ঝাউগাছের উপর থেকে নীচে এসে খাড়া হয়ে দাঁড়ালো। বললে, পুপেদিদিকে কে চুরি করে নিয়ে যায়। শুনে খরগোষ এমন দৌড় দৌড়ল যে ব্যাঙ্গমাদাদা পারল না তাকে ধরতে।--আচ্ছা, তার পরে?
কার পরে।
খরগোষ তো নিয়ে গেল, তার পরে কী হল বলো-না।
আমি কী বলব। তোমাকেই তো বলতে হবে।
বাঃ, আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, কেমন করে জানব।
সেই তো মুশকিল হয়েছে। ঠিকানাই পাচ্ছি নে কোথায় তোমাকে নিয়ে গেল। উদ্ধার করতে যাই কোন্ রাস্তায়। একটা কথা জিগেস করি যখন রাস্তা দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিল, ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছিলে কি।
হাঁ হাঁ, পাচ্ছিলুম ঢঙ ঢঙ ঢঙ।
তা হলে রাস্তাটা সোজা গেছে ঘণ্টাকর্ণদের পাড়া দিয়ে।
ঘণ্টাকর্ণ! তারা কিরকম।
তাদের দুটো কান দুটো ঘণ্টা। আর, দুটো লেজে দুটো হাতুড়ি। লেজের ঝাপটা দিয়ে একবার এ কানে বাজায় ঢঙ, একবার ও কানে বাজায় ঢঙ। দু জাতের ঘণ্টাকর্ণ আছে, একটা আছে হিংস্র, কাঁসরের মতো খন্খন্ আওয়াজ দেয়; আর একটার গমগম গম্ভীর শব্দ।
তুমি কখনো তার শব্দ শুনতে পাও, দাদামশায়?
পাই বই কি। এই, কাল রাত্তিরেই বই পড়তে পড়তে হঠাৎ শুনলেম ঘণ্টাকর্ণ চলেছেন ঘোর অন্ধকারের ভিতর দিয়ে। বারোটা বাজালেন যখন তখন আর থাকতে পারলুম না। তাড়াতাড়ি বই ফেলে দিয়ে চমকে উঠে দৌড় দিলুম বিছানায়, বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বুজে রইলুম পড়ে।
খরগোষের সঙ্গে ঘণ্টাকর্ণের ভাব আছে?
খুব ভাব। খরগোষটা তারই আওয়াজের দিকে কান পেতে চলতে থাকে সপ্তর্ষিপাড়ার ছায়াপথ দিয়ে।
তার পরে?
তার পরে যখন একটা বাজে, দুটো বাজে, তিনটে বাজে, চারটে বাজে, পাঁচটা বাজে, তখন রাস্তা শেষ হয়ে যায়।
তার পরে?
তার পরে পৌঁছয় তন্দ্রা-তেপান্তরের ও পারে আলোর দেশে। আর দেখা যায় না।
আমি কি পৌঁচেছি সেই দেশে।
নিশ্চয় পৌঁচেছ।
এখন তা হলে আমি খরগোষের পিঠে নেই?
থাকলে যে তার পিঠ ভেঙে যেত।
ওঃ, ভুলে গেছি, এখন আমি ভারি হয়েছি। তার পরে?
তার পরে তোমাকে উদ্ধার করা চাই তো।
নিশ্চয় চাই। কেমন করে করবে।
সেই কথাটাই তো ভাবছি। রাজপুত্তুরের শরণ নিতে হল দেখছি।
কোথায় পাবে।
ঐ-যে তোমাদের সুকুমার।
শুনে এক মুহূর্তে তোমার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। একটু কঠিন সুরেই বললে, তুমি তাকে খুব ভালোবাস। তোমার কাছে সে পড়া ব'লে নিতে আসে। তাই তো সে আমাকে অঙ্কে এগিয়ে যায়।
এগিয়ে যাবার অন্য স্বাভাবিক কারণও আছে। সে কথাটার আলোচনা করলুম না। বললুম তা, তাকে ভালোবাসি আর না বাসি, সেই আছে এক রাজপুত্তুর।
কেমন করে জানলে।
আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করে তবে সে ঐ পদটা পাকা করে নিয়েছে।
তুমি বেশ একটু ভুরু কুঁচকে বললে, তোমারই সঙ্গে ওর যত বোঝাপড়া!
কী করি বলো, কোনোমতে ও মানতে চায় না-- ওর চেয়ে আমি বয়সে খুব বেশি বড়ো।
ওকে তুমি বল রাজপুত্তুর! ওকে আমি জটায়ুপাখি ব'লেও মনে করি নে। ভারি তো!
একটু শান্ত হও, এখন ঘোর বিপদে পড়া গেছে! তুমি কোথায় তার তো ঠিকানাই নেই। তা, এবারকার মতো কাজ উদ্ধার করে দিক, আমরা নিশ্বেস ফেলে বাঁচি। এর পরে ওকে সেতুবন্ধনের কাঠবিড়ালি বানিয়ে দেব।
উদ্ধার করতে ও রাজি হবে কেন। ওর এক্জামিনের পড়া আছে।
রাজি হবার বারো-আনা আশা আছে। এই পর্শু শনিবারে ওদের ওখানে গিয়েছিলুম। বেলা তিনটে। সেই রোদ্দুরে মাকে ফাঁকি দিয়ে ও দেখি ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ির ছাদে। আমি বললুম, ব্যাপার কী।
ঝাঁকানি দিয়ে মাথাটা উপরে তুলে বললে, আমি রাজপুত্তুর।
তলোয়ার কোথায়।
দেয়ালির রাত্রে ওদের ছাদে আধপোড়া তুবড়িবাজির একটা কাঠি পড়েছিল, কোমরে সেইটেকে ফিতে দিয়ে বেঁধেছে! আমাকে দেখিয়ে দিলে।
আমি বললুম, তলোয়ার বটে। কিন্তু, ঘোড়া চাই তো?
বললে, আস্তাবলে আছে।
ব'লে ছাদের কোণ থেকে ওর জ্যাঠামশায়ের বহুকেলে বেহায়া একটা ছেঁড়া ছাতা টেনে নিয়ে এল। দুই পায়ের মধ্যে তাকে চেপে ধরে হ্যাট্হ্যাট্ আওয়াজ করতে করতে ছাদময় একবার দৌড় করিয়ে আনলে। আমি বললুম, ঘোড়া বটে!
এর পক্ষীরাজের চেহারা দেখতে চাও?
চাই বই কি।
ছাতাটা ফস্ করে খুলে দিলে। ছাতার পেটের মধ্যে ঘোড়ার খাবার দানা ছিল, সেগুলো ছড়িয়ে পড়ল ছাদে।
আমি বললুম, আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! এ জন্মে পক্ষীরাজ দেখব, কোনোদিন এমন আশাই করি নি।
এইবার আমি উড়ছি, দাদা। চোখ বুজে থাকো, তা হলে বুঝতে পারবে, আমি ঐ মেঘের কাছে গিয়ে ঠেকেছি। একেবারে অন্ধকার!
চোখ বোজবার দরকার করে না আমার। স্পষ্টই জানতে পারছি, তুমি খুব উড়ছ, পক্ষীরাজের ডানা মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
আচ্ছা, দাদামশায়, আমার ঘোড়াটার একটা নাম দিয়ে দাও তো।
আমি বললুম, ছত্রপতি।
নামটা পছন্দ হল। রাজপুত্তুর ছাতার পিঠ চাপ্ড়িয়ে বললে, ছত্রপতি!
নিজেই ঘোড়ার হয়ে তার জবাব দিলে, আজ্ঞে!
আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে, তুমি ভাবছ, আমি বললুম। আজ্ঞে, তা নয়, ঘোড়া বললে।
সে কথাও কি আমাকে বলতে হবে। আমি কি এত কালা।
রাজপুত্তুর বললে, ছত্রপতি, আর ভালো লাগছে না চুপচাপ পড়ে থাকতে।
তারই মুখ থেকে উত্তর পাওয়া গেল, কী হুকুম বলো।
তেপান্তরের মাঠ পেরোনো চাই।
রাজি আছি।
আমি তো আর থাকতে পারি নে, কাজ আছে; রসে ভঙ্গ দিয়ে বলতে হল, রাজপুত্তুর, কিন্তু তোমার মাস্টার যে বসে আছে। দেখে এলুম, তার মেজাজটা চটা।
শুনে রাজপুত্রের মনটা ছট্ফট্ করে উঠল। ছাতাটাকে থাব্ড়া মেরে বললে, এখ্খনি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পার না কি।
বেচারা ঘোড়ার হয়ে আমাকেই বলতে হল, রাত্তির না হলে ও তো উড়তে পারে না। দিনের বেলায় ও ন্যাকামি ক'রে ছাতা সাজে; তুমি ঘুমোলেই ও ডানা মেলবে। এখনকার মতো পড়তে যাও, নইলে বিপদ বাধবে।
সুকুমার মাস্টারের কাছে পড়তে গেল। যাবার সময় আমাকে বললে, কিন্তু সব কথা এখনো শেষ হয় নি।
আমি বললুম, কথা কি কখনোই শেষ হতে পারে। শেষ হলে মজা কিসের।
পাঁচটায় সময় পড়া শেষ হয়ে যাবে। দাদু, তখন তুমি এসো।
আমি বললুম, থর্ড্নম্বর রীডরের পরে মুখ বদলাবার জন্যে পয়লা নম্বরের গল্প চাই। নিশ্চয় আসব।