সার্কাস দেখে আসার পর থেকে পুপুদিদির মনটা যেন বাঘের বাসা হয়ে উঠল। বাঘের সঙ্গে, বাঘের মাসির সঙ্গে সর্বদা তার আলাপ চলছে। আমরা কেউ যখন থাকি নে তখনই ওদের মজলিস জমে। আমার কাছে নাপিতের খবর নিচ্ছিল; আমি বললুম, নাপিতের কী দরকার।

পুপু জানালে, বাঘ ওকে অত্যন্ত ধরে পড়েছে। খোঁচা খোঁচা হয়ে উঠেছে ওর গোঁফ, ও কামাতে চায়।

আমি জিগেস করলেম, গোঁফ কামানোর কথা ওর মনে এল কী করে।

পুপু বললে, চা খেয়ে বাবার পেয়ালায় তলানি যেটুকু বাকি থাকে আমি বাঘকে খেতে দিই। সেদিন তাই খেতে এসে ও দেখতে পেয়েছিল পাঁচুবাবুকে; ওর বিশ্বাস, গোঁফ কামালে ওর মুখখানা দেখাবে ঠিক পাঁচুবাবুরই মতো।

আমি বললুম, সেটা নিতান্ত অন্যায় ভাবে নি। কিন্তু, একটু মুশকিল আছে। কামানোর শুরুতেই নাপিতকে যদি শেষ করে দেয় তা হলে কামানো শেষ হবেই না।

শুনেই ফস্‌ ক'রে পুপের মাথায় বুদ্ধি এল; ব'লে ফেললে, জান দাদামশায়? বাঘরা কখ্‌খনো নাপিতকে খায় না।

আমি বললুম, বল কী। কেন বলো দেখি।

খেলে ওদের পাপ হয়।

ওঃ, তা হ'লে কোনো ভয় নেই। এক কাজ করা যাবে, চৌরঙ্গিতে সাহেব-নাপিতের দোকানে নিয়ে যাওয়া যাবে।

পুপে হাততালি দিয়ে বলে উঠল, হাঁ হাঁ, ভারি মজা হবে। সাহেবের মাংস নিশ্চয় খাবে না, ঘেন্না করবে।

খেলে গঙ্গাস্নান করতে হবে। খাওয়া-ছোঁওয়ায় বাঘের এত বাছবিচার আছে, তুমি জানলে কী করে, দিদি।

পুপু খুব সেয়ানার মতো মুখ টিপে হেসে বললে, আমি সব জানি।

আর, আমি বুঝি জানি নে?

কী জান, বলো তো।

ওরা কখনো চাষী কৈবর্তর মাংস খায় না; বিশেষত যারা গঙ্গার পশ্চিম-পারে থাকে। শাস্ত্রে বারণ।

আর, যারা পুব-পারে থাকে?

তারা যদি জেলে কৈবর্ত হয় তো সেটা অতি পবিত্র মাংস। সেটা খাবার নিয়ম বাঁ থাবা দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে।

বাঁ থাবা কেন।

ঐটে হচ্ছে শুদ্ধ রীতি। ওদের পণ্ডিতরা ডান থাবাকে নোংরা বলে। একটি কথা জেনে রাখো দিদি, নাপতিনীদের 'পরে ওদের ঘেন্না। নাপতিনীরা যে মেয়েদের পায়ে আল্‌তা লাগায়।

তা লাগালেই বা?

সাধু বাঘেরা বলে, আলতাটা রক্তের ভান, ওটা আঁচ্‌ড়ে কাম্‌ড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে বের করা রক্ত নয়, ওটা মিথ্যাচার। এরকম কপটাচরণকে ওরা অত্যন্ত নিন্দে করে। একবার একটা বাঘ ঢুকেছিল পাগড়িওয়ালার ঘরে, সেখানে ম্যাজেণ্টা গোলা ছিল গামলায়। রক্ত মনে ক'রে মহা খুশি হয়ে মুখ ডুবোলে তার মধ্যে। সে একেবারে পাকা রঙ। বাঘের দাড়ি গোঁফ, তার দুই গাল, লাল টক্‌টকে হয়ে উঠল। নিবিড় বনে যেখানে বাঘেদের পুরুতপাড়া মোষমারা গ্রামে, সেইখানে আসতেই ওদের আঁচাড়ি শিরোমণি ব'লে উঠল, এ কী কাণ্ড! তোমার সমস্ত মুখ লাল কেন। ও লজ্জায় প'ড়ে মিথ্যে করে বললে, গণ্ডার মেরে তার রক্ত খেয়ে এসেছি। ধরা পড়ে গেল মিথ্যে। পণ্ডিতজি বললে, নখে তো রক্তের চিহ্ন দেখি নে; মুখ শুঁকে বললে, মুখে তো রক্তের গন্ধ নেই। সবাই বলে উঠল, ছি ছি! এ তো রক্তও নয়, পিত্তও নয়, মগজও নয়, মজ্জাও নয়-- নিশ্চয় মানুষের পাড়ায় গিয়ে এমন একটা রক্ত খেয়েছে যা নিরামিষ রক্ত, যা অশুচি। পঞ্চায়েত বসে গেল। কামড়বিশারদ-মশায় হুঙ্কার দিয়ে বললে, প্রায়শ্চিত্ত করা চাই। করতেই হল।

যদি না করত।

সর্বনাশ! ও যে পাঁচ-পাঁচটা মেয়ের বাপ; বড়ো বড়ো খরনখিনীর গৌরীদানের বয়স হয়ে এসেছে। পেটের নীচে লেজ গুটিয়ে সাত গণ্ডা মোষ পণ দিতে চাইলেও বর জুটবে না। এর চেয়েও ভয়ংকর শাস্তি আছে।

কী রকম।

ম'লে শ্রাদ্ধ করবার জন্যে পুরুত পাওয়া যাবে না, শেষ কালে হয়তো বেতজঙ্গল গাঁ থেকে নেকড়ে-বেঘো পুরুত আনতে হবে; সে ভারি লজ্জা, সাত পুরুষের মাথা হেঁট।

শ্রাদ্ধ নাই বা হল।

শোনো একবার। বাঘের ভূত যে না খেয়ে মরবে।

সে তো মরেইছে, আবার মরবে কী ক'রে।

সেই তো আরও বিপদ। না খেয়ে মরা ভালো, কিন্তু ম'রে না খেয়ে বেঁচে থাকা যে বিষম দুর্গ্রহ।

পুপুদিদিকে ভাবিয়ে দিলে। খানিকক্ষণ বাদে ভুরু কুঁচ্‌কিয়ে বললে, ইংরেজের ভূত তা হলে খেতে পায় কী ক'রে।

তারা বেঁচে থাকতে যা খেয়েছে তাতেই তাদের সাত জন্ম অমনি চ'লে যায়। আমরা যা খাই তাতে বৈতরণী পার হবার অনেক আগেই পেট চোঁ-চোঁ করতে থাকে।

সন্দেহ মীমাংসা হতেই পুপে জিগেস করলে, প্রায়শ্চিত্ত কিরকম হল।

আমি বললুম, হাঁকবিদ্যা-বাচস্পতি বিধান দিলে যে, বাঘাচণ্ডীতলার দক্ষিণপশ্চিম কোণে কৃষ্ণপঞ্চমী তিথি থেকে শুরু করে অমাবস্যার আড়াই পহর রাত পর্যন্ত ওকে কেবল খ্যাঁক্‌শেয়ালির ঘাড়ের মাংস খেয়ে থাকতে হবে; তাও হয় ওর পিসতুতো বোন কিম্বা মাসতুতো শ্যালার মেজো ছেলে ছাড়া আর কেউ শিকার করলে হবে না-- আর, ওকে খেতে হবে পিছনের ডান দিকের থাবা দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে। এত বড়ো শাস্তির হুকুম শুনেই গা বমি-বমি করে এল; চার পায়ে হাত জোড় করে হাউ-হাউ করতে লাগল।

কেন, কী এমন শাস্তি।

বল কী, খ্যাঁক্‌শিয়ালির মাংস! যত দূর অশুচি হতে হয়। বাঘটা দোহাই পেড়ে বললে, আমাকে বরঞ্চ নেউলের লেজ খেতে বলো সেও রাজি, কিন্তু খ্যাঁক্‌শেয়ালির ঘাড়ের মাংস!

শেষকালে কি খেতে হল।

হল বই কি।

দাদামশায়, বাঘেরা তা হলে খুব ধার্মিক?

ধার্মিক না হলে কি এত নিয়ম বাঁচিয়ে চলে। সেইজন্যেই তো শেয়ালরা ওদের ভারি ভক্তি করে। বাঘের এঁটো প্রসাদ পেলে ওরা বর্তিয়ে যায়। মাঘের ত্রয়োদশীতে যদি মঙ্গলবার পড়ে তা হলে সেদিন ভোর রাত্তিরে ঠিক দেড় প্রহর থাকতে বুড়ো বাঘের পা চেটে আসা শেয়ালদের ভারি পুণ্যকর্ম। কত শেয়াল প্রাণ দিয়েছে এই পুণ্যের জন্যে।

পুপুর বিষম খটকা লাগল। বললে, বাঘরা এতই যদি ধার্মিক হবে তা হলে জীবহত্যে করে কাঁচা মাংস খায় কী করে।

সে বুঝি যে-সে মাংস। ও-যে মন্ত্র দিয়ে শোধন করা।

কিরকম মন্ত্র।

ওদের সনাতন হালুম-মন্ত্র। সেই মন্ত্র প'ড়ে তবে ওরা হত্যা করে। তাকে কি হত্যা বলে।

যদি হালুম-মন্ত্র বলতে ভুলে যায়।

বাঘপুঙ্গব-পণ্ডিতের মতে তা হলে ওরা বিনা মন্ত্রে যে জীবকে মারে পরজন্মে সেই জীব হয়েই জন্মায়। ওদের ভারি ভয় পাছে মানুষ হয়ে জন্মাতে হয়।

কেন।

ওরা বলে, মানুষের সর্বাঙ্গ টাক-পড়া,কী কুশ্রী! তার পরে, সামান্য একটা লেজ, তাও নেই মানুষের দেহে। পিঠের মাছি তাড়াবার জন্যেই ওদের বিয়ে করতে হয়। আবার দেখো-না, ওরা খাড়া দাঁড়িয়ে সঙের মতো দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে-- দেখে আমরা হেসে মরি। আধুনিক বাঘের মধ্যে সব চেয়ে বড়ো জ্ঞানী শার্দৌল্যতত্ত্বরত্ন বলেন, জীবসৃষ্টির শেষের পালায় বিশ্বকর্মার মালমসলা যখন সমস্তই কাবার হয়ে গেল তখনই মানুষ গড়তে তাঁর হঠাৎ শখ হল। তাই বেচারাদের পায়ের তলার জন্যে থাবা দূরে থাক্‌ কয়েক-টুকরো খুরের জোগাড় করতে পারলেন না, জুতো প'রে তবে ওরা পায়ের লজ্জা নিবারণ করতে পারে-- আর, গায়ের লজ্জা ঢাকে ওরা কাপড়ে জড়িয়ে। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ওরাই হল লজ্জিত জীব। এত লজ্জা জীবলোকে আর কোথাও নেই।

বাঘেদের বুঝি ভারি অহংকার?

ভয়ংকর। সেইজন্যেই তো ওরা এত ক'রে জাত বাঁচিয়ে চলে। জাতের দোহাই পেড়ে একটা বাঘের খাওয়া বন্ধ করেছিল একজন মানুষের মেয়ে; তাই নিয়ে আমাদের সে একটা ছড়া বানিয়েছে।

তোমার মতো সে আবার ছড়া বানাতে পারে নাকি।

তার নিজের বিশ্বাস সে পারে, এই তর্ক নিয়ে তো পুলিস ডাকা যায় না।

আচ্ছা, শোনাও-না।

তবে শোনো।--

এক ছিল মোটা কেঁদো বাঘ,

গায়ে তার কালো কালো দাগ।

বেহারাকে খেতে ঘরে ঢুকে

আয়নাটা পড়েছে সমুখে।

এক ছুটে পালালো বেহারা,

বাঘ দেখে আপন চেহারা।

গাঁ-গাঁ ক'রে ডেকে ওঠে রাগে,

দেহ কেন ভরা কালো দাগে।

ঢেঁকিশালে পুঁটু ধান ভানে,

বাঘ এসে দাঁড়ালো সেখানে।

ফুলিয়ে ভীষণ দুই গোঁফ

বলে, চাই গ্লিসেরিন সোপ।

পুঁটু বলে, ও কথাটা কী যে

জন্মেও জানি নে তা নিজে।

ইংরেজি-টিংরেজি কিছু

শিখি নি তো, জাতে আমি নিচু।

বাঘ বলে, কথা বল ঝুঁটো,

নেই কি আমার চোখ দুটো।

গায়ে কিসে দাগ হল লোপ

না মাখিলে গ্লিসেরিন সোপ।

পুঁটু বলে, আমি কালো কৃষ্টি,

কখনো মাখি নি ও জিনিসটি।

কথা শুনে পায় মোর হাসি,

নই মেম-সাহেবের মাসি।

বাঘ বলে, নেই তোর লজ্জা?

খাব তোর হাড় মাস মজ্জা।

পুঁটু বলে, ছি ছি ওরে বাপ,

মুখেও আনিলে হবে পাপ।

জান না কি আমি অস্পৃশ্য,

মহাত্মা গাঁধিজির শিষ্য।

আমার মাংস যদি খাও

জাত যাবে জান না কি তাও।

পায়ে ধরি করিয়ো না রাগ!--

ছুঁস নে ছুঁস নে, বলে বাঘ,

আরে ছি ছি, আরে রাম রাম,

বাঘনাপাড়ায় বদনাম

রটে যাবে; ঘরে মেয়ে ঠাসা,

ঘুচে যাবে বিবাহের আশা

দেবী বাঘা-চণ্ডীর কোপে।

কাজ নেই গ্লিসেরিন সোপে।

জান, পুপুদিদি? আধুনিক বাঘেদের মধ্যে ভারি একাট কাণ্ড চলছে-- যাকে বলে প্রগতি, প্রচেষ্টা। ওদের প্রগতিওয়ালা প্রচারকেরা বাঘ-সমাজে ব'লে বেড়াচ্ছে যে, অস্পৃশ্য ব'লে খাদ্য বিচার করা পবিত্র জন্তু-আত্মার প্রতি অবমাননা। ওরা বলছে, আজ থেকে আমরা যাকে পাব তাকেই খাব; বাঁ থাবা দিয়ে খাব, ডান থাবা দিয়ে খাব, পিছনের থাবা দিয়েও খাব; হালুম-মন্ত্র পড়েও খাব, না পড়েও খাব-- এমন কি, বৃহস্পতিবারেও আঁচ্‌ড়ে খাব, শনিবারেও আমরা কাম্‌ড়ে খাব। এত ঔদার্য। এই বাঘেরা যুক্তিবাদী এবং সর্বজীবে এদের সম্মানবোধ অত্যন্ত ফলাও। এমন কি, এরা পশ্চিম-পারের চাষী কৈবর্তদেরও খেতে চায়, এতই এদের উদার মন। ঘোরতর দলাদলি বেধে গেছে। প্রাচীনরা নব্য সম্প্রদায়কে নাম দিয়েছে চাষী-কৈবর্ত-খেগো, এই নিয়ে মহা হাসাহাসি পড়েছে।

পুপু বললে, আচ্ছা দাদামশায়, তুমি কখনো বাঘের উপর কবিতা লিখেছ?

হার মানতে মন গেল না। বললুম, হ্যাঁ লিখেছি।

শোনাও-না।

গম্ভীর সুরে আবৃত্তি করে গেলুম--

তোমার সৃষ্টিতে কভু শক্তিরে কর না অপমান,

হে বিধাতা-- হিংসারেও করেছ প্রবল হস্তে দান

আশ্চর্য মহিমা এ কী। প্রখরনখর বিভীষিকা,

সৌন্দর্য দিয়েছ তারে, দেহধারী যেন বজ্রশিখা,

যেন ধূর্জটির ক্রোধ। তোমার সৃষ্টির ভাঙে বাঁধ

ঝঞ্ঝা উচ্ছৃঙ্খল, করে তোমার দয়ার প্রতিবাদ

বনের যে দস্যু সিংহ, সিংহ, ফেনজিহ্ব ক্ষুব্ধ সমুদ্রের

যে উদ্ধত ঊর্ধ্ব ফণা, ভূমিগর্ভে দানবযুদ্ধের

ডমরুনিঃস্বনী স্পর্ধা, গিরিবক্ষভেদী বহ্নিশিখা

যে আঁকে দিগন্তপটে আপন জ্বলন্ত জয়টিকা,

প্রলয়নর্তিনী বন্যা বিনাশের মদিরবিহ্বল

নির্লজ্জ নিষ্ঠুর-- এই যত বিশ্ববিপ্লবীর দল

প্রচণ্ড সুন্দর। জীবলোকে যে দুর্দান্ত আনে ত্রাস

হীনতালাঞ্ছনে সে তো পায় না তোমার পরিহাস।

চুপ করে রইল পুপু। আমি বললুম, কী দিদি, ভালো লাগল না বুঝি।

ও কুণ্ঠিত হয়ে বললে, না না, ভালো লাগবে না কেন। কিন্তু, এর মধ্যে বাঘটা কোথায়।

আমি বললুম, যেমন সে থাকে ঝোপের মধ্যে, দেখা যায় না তবু আছে ভয়ংকর গোপনে।

পুপু বললে, অনেক দিন আগে গ্লিসেরিন-সোপ-খোঁজা বাঘের কথা আমাকে বলেছিলে। তার খবরটা কোথা থেকে পেলে সে।

আমার কথা ও করে চুরি, নিজের মুখে সেটা দেয় বসিয়ে।

কিন্তু--

'কিন্তু' না তো কী। লিখেছে ভালোই।

কিন্তু--

হ্যাঁ ঠিক কথা। আমি অমন করে লিখি নে, হয়তো লিখতে পারি নে। আমার মালটা ও চুরি করে, তার পরে যখন পালিস ক'রে দেয় তখন চেনা শক্ত হয়-- এমন ঢের দেখেছি। ঠিক ঐরকম আর-একটি ছড়া বানিয়েছে।

শোনাও-না।

আচ্ছা, শোনো তবে।--

সুঁদরবনের কেঁদো বাঘ,

সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ।

যথাকালে ভোজনের

কম হলে ওজনের

হত তার ঘোরতর রাগ।

একদিন ডাক দিল গাঁ-গাঁ--

বলে, তোর গিন্নিকে জাগা।

শোন্‌ বটুরাম ন্যাড়া,

পাঁচ জোড়া চাই ভ্যাড়া,

এখনি ভোজের পাত লাগা।

বটু বলে, এ কেমন কথা,

শিখেছ কি এই ভদ্রতা।

এত রাতে হাঁকাহাঁকি

ভালো না, জান না তা কি,

আদবের এ যে অন্যথা।

মোর ঘর নেহাত জঘন্য,

মহাপশু, হেথায় কী জন্য।

ঘরেতে বাঘিনী মাসি

পথ চেয়ে উপবাসী,

তুমি খেলে মুখে দেবে অন্ন।

সেথা আছে গোসাপের ঠ্যাঙ।

আছে তো শুট্‌কে কোলা ব্যাঙ।

আছে বাসি খরগোষ,

গন্ধে পাইবে তোষ,

চলে যাও নেচে ড্যাঙ ড্যাঙ।

নইলে কাগজে প্যারাগ্রাফ

রটিবে, ঘটিবে পরিতাপ--

বাঘ বলে, রামো, রামো,

বাক্যবাগীশ থামো,

বকুনির চোটে ধরে হাঁপ।

তুমি ন্যাড়া, আস্ত পাগল,

বেরোও তো, খোলো তো আগল।

ভালো যদি চাও তবে

আমারে দেখাতে হবে

কোন্‌ ঘরে পুষেছ ছাগল।

বটু কহে, এ কী অকরণ,

ধরি তব চতুশ্চরণ--

জীববধ মহাপাপ,

তারো বেশি লাগে শাপ

পরধন করিলে হরণ।

বাঘ শুনে বলে, হরি হরি,

না খেয়ে আমিই যদি মরি,

জীবেরই নিধন তাহা--

সহমরণেতে আহা

মরিবে যে বাঘী সুন্দরী।

অতএব ছাগলটা চাই,

না হলে তুমিই আছ ভাই।

এত বলি তোলে থাবা।

বটুরাম বলে, বাবা,

চলো ছাগলেরই ঘরে যাই।

দ্বার খুলে বলে, পড়ো ঢুকে,

ছাগল চিবিয়ে খাও সুখে।

বাঘ সে ঢুকল যেই,

দ্বিতীয় কথাটি নেই,

বাহিরে শিকল দিল রুখে।

বাঘ বলে, এ তো বোঝা ভার,

তামাসার এ নহে আকার।

পাঁঠার দেখি নে টিকি,

লেজের সিকির সিকি

নেই তো, শুনি নে ভ্যাভ্যাকার।

ওরে হিংসুক সয়তান,

জীবের বধিতে চাস্‌ প্রাণ!

ওরে ক্রূর, পেলে তোরে

থাবায় চাপিয়া ধ'রে

রক্ত শুষিয়া করি পান--

ঘরটাও ভীষণ ময়লা--

বটু বলে, মহেশ গয়লা

ও ঘরে থাকিত, আজ

থাকে তোর যমরাজ

আর থাকে পাথুরে কয়লা।

গোঁফ ফুলে ওঠে যেন ঝাঁটা,

বাঘ বলে, গেল কোথা পাঁঠা!

বটুরাম বলে নেচে,

এই পেটে তলিয়েছে,

খুঁজিলে পাবে না সারা গাঁটা।

ভালো লাগল?

তা, যাই বলো দাদামশায়, কিন্তু বাঘের ছড়া খুব ভালো লিখেছে।

আমি বললুম, তা হবে, হয়তো ভালোই লিখেছে। কিন্তু, ও ভালো লেখে কি আমি ভালো লিখি সে সম্বন্ধে শেষ অভিমতটা দেবার জন্যে অন্তত আরো দশটা বছর অপক্ষো কোরো।

পুপু বললে, আমার বাঘ কিন্তু আমাকে খেতে আসে না।

সে তো তোমাকে প্রত্যক্ষ দেখেই বুঝতে পারছি। তোমার বাঘ কী করে।

রাত্তিরে যখন শুয়ে থাকি বাইরে থেকে ও জানলা আঁচড়ায়। খুলে দিলেই হাসে।

তা হতে পারে, ওরা খুব হাসিয়ে জাত। ইংরেজিতে যাকে বলে হিউমরাস্‌। কথায় কথায় দাঁত বের করে।
1...3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11...15