জিগেস করলুম, কিছু বলবার আছে?
ও বললে, আছে।
চট্ ক'রে বলে ফেলো, আমাকে এখনি বেরতে হবে।
কোথায়।
লাটসাহেবের বাড়ি।
লাটসাহেব তোমাকে ডাকেন নাকি।
না, ডাকেন না, ডাকলে ভালো করতেন।
ভালো কিসের।
জানতে পারতেন, ওঁরা যাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে থাকেন আমি তাদের চেয়েও খবর বানাতে ওস্তাদ। কোনো রায়বাহাদুর আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না, সে কথা তুমি জান।
জানি, কিন্তু আমাকে নিয়ে আজকাল তুমি যা-তা বলছ।
অসম্ভব গল্পেরই যে ফর্মাশ।
হোক-না অসম্ভব, তারও তো একটা বাঁধুনি থাকা চাই। এলোমেলো অসম্ভব তো যে-সে বানাতে পারে।
তোমার অসম্ভবের একটা নমুনা দাও।
আচ্ছা বলি শোনো--
স্মৃতিরত্নমশায় মোহনবাগানের গোল-কীপারি ক'রে ক্যাল্কাটার কাছ থেকে একে একে পাঁচ গোল খেলেন। খেয়ে খিদে গেল না, উল্টো হল, পেট চোঁ-চোঁ করতে লাগল। সামনে পেলেন অক্টর্লনি মন্যুমেণ্ট। নীচে থেকে চাটতে চাটতে চুড়ো পর্যন্ত দিলেন চেটে। বদরুদ্দিন মিঞা সেনেট-হলে বসে জুতো সেলাই করছিল, সে হাঁ-হাঁ ক'রে ছুটে এল। বললে, আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে এত বড়ো জিনিসটাকে এঁটো করে দিলেন!
'তোবা তোবা' ব'লে তিনবার মন্যুমেণ্টের গায়ে থুথু ফেলে মিঞাসাহেব দৌড়ে গেল স্টেট্ম্যান-আপিসে খবর দিতে।
স্মৃতিরত্নমশায়ের হঠাৎ চৈতন্য হল, মুখটা তাঁর অশুদ্ধ হয়েছে। গেলেন ম্যুজিয়মের দরোয়ানের কাছে। বললেন, পাঁড়েজি, তুমিও ব্রাহ্মণ, আমিও ব্রাহ্মণ-- একটা অনুরোধ রাখতে হবে।
পাঁড়েজি দাড়ি চুম্রিয়ে নিয়ে সেলাম ক'রে বললে, কোমা ভূ পোর্তে ভূ সি ভূ প্লে।
পণ্ডিতমশায় একটু চিন্তা ক'রে বললেন, বড়ো শক্ত প্রশ্ন, সাংখ্যকারিকা মিলিয়ে দেখে কাল জবাব দিয়ে যাব। বিশেষ আজ আমার মুখ অশুদ্ধ, আমি মন্যুমেণ্ট চেটেছি।
পাঁড়েজি দেশালাই দিয়ে বর্মা চুরুট ধরালো। দু টান টেনে বললে, তা হলে এক্ষুনি খুলুন ওয়েব্স্টার ডিক্সনারি, দেখুন বিধান কী।
স্মৃতিরত্ন বললেন, তা হলে তো ভাটপাড়ায় যেতে হয়। সে পরে হবে, আপাতত তোমার ঐ পিতলে-বাঁধানো ডাণ্ডাখানা চাই।
পাঁড়ে বললে, কেন, কী করবেন, চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়েছে বুঝি?
স্মৃতিরত্ন বললেন, তুমি খবর পেলে কেমন ক'রে। সে তো পড়েছিল পরশু দিন। ছুটতে হল উল্টোডিঙিতে যকৃত-বিকৃতির বড়ো ডাক্তার ম্যাকর্টনি সাহেবের কাছে। তিনি নারকেলডাঙা থেকে সাবল আনিয়ে সাফ করে দিলেন।
পাঁড়েজি বললে, তবে ডাণ্ডায় তোমার কী প্রয়োজন।
পণ্ডিত মশায় বললেন, দাঁতন করতে হবে।
পাঁড়েজি বললে, ওঃ, তাই বলো, আমি বলি নাকে কাঠি দিয়ে হাঁচবে বুঝি, তা হলে আবার গঙ্গাজল দিয়ে শোধন করতে হত।
এই পর্যন্ত বলে গুড়্গুড়িটা কাছে নিয়ে দু টান টেনে সে বললে, দেখো দাদা, এইরকম তোমার বানিয়ে বলবার ধরন। এ যেন আঙুল দিয়ে না লিখে গণেশের শুঁড় দিয়ে লম্বা চালে বাড়িয়ে লেখা। যেটাকে যেরকম জানি সেটাকে অন্যরকম করে দেওয়া। অত্যন্ত সহজ কাজ। যদি বল লাটসাহেব কলুর ব্যাবসা ধ'রে বাগবাজারে শুটকি মাছের দোকান খুলেছেন, তবে এমন সস্তা ঠাট্টায় যারা হাসে তাদের হাসির দাম কিসের।
চটেছ ব'লে বোধ হচ্ছে।
কারণ আছে। আমাকে নিয়ে পুপুদিদিকে সেদিন যাচ্ছে-তাই কতকগুলো বাজে কথা বলেছিলে। নিতান্ত ছেলেমানুষ ব'লেই দিদি হাঁ করে সব শুনেছিল। কিন্তু, অদ্ভুত কথা যদি বলতেই হয় তবে তার মধ্যে কারিগরি চাই তো।
সেটা ছিল না বুঝি?
না,ছিল না। চুপ করে থাকতুম যদি আমাকে সুদ্ধ না জড়াতে। যদি বলতে, তোমার অতিথিকে তুমি জিরাফের মুড়িঘণ্ট খাইয়েছ, শর্ষেবাঁটা দিয়ে তিমিমাছ-ভাজা আর পোলাওয়ের সঙ্গে পাঁকের থেকে টাটকা ধরে আনা জলহস্তী, আর তার সঙ্গে তালের গুঁড়ির ডাঁটা-চচ্চড়ি, তা হলে আমি বলতুম, ওটা হল স্থূল। ওরকম লেখা সহজ।
আচ্ছা, তুমি হলে কী রকম লিখতে।
বলি, রাগ করবে না? দাদা, তোমার চেয়ে আমার কেরামতি যে বেশি তা নয়, কম ব'লেই সুবিধে। আমি হলে বলতুম--
তাসমানিয়াতে তাস খেলার নেমন্তন্ন ছিল, যাকে বলে দেখা-বিন্তি। সেখানে কোজুমাচুকু ছিলেন বাড়ির কর্তা, আর গিন্নির নাম ছিল শ্রীমতী হাঁচিয়েন্দানি কোরুঙ্কুনা। তাঁদের বড়ো মেয়ের নাম পাম্কুনি দেবী, স্বহস্তে রেঁধেছিলেন কিণ্টিনাবুর মেরিউনাথু, তার গন্ধ যায় সাত পাড়া পেরিয়ে। গন্ধে শেয়ালগুলো পর্যন্ত দিনের বেলা হাঁক ছেড়ে ডাকতে আরম্ভ করে নির্ভয়ে, লোভে কি ক্ষোভে জানি নে; কাকগুলো জমির উপর ঠোঁট গুঁজে দিয়ে মরিয়া হয়ে পাখা ঝাপটায় তিন ঘণ্টা ধরে। এ তো গেল তরকারি। আর, জালা জালা ভর্তি ছিল কাঙ্চুটোর সাঙ্চানি। সে দেশের পাকা পাকা আঁক্সুটো ফলের ছোবড়া-চোঁয়ানো। এই সঙ্গে মিষ্টান্ন ছিল ইক্টিকুটির ভিক্টিমাই, ঝুড়িভর্তি। প্রথমে ওদের পোষা হাতি এসে পা দিয়ে সেগুলো দ'লে দিল; তার পরে ওদের দেশের সব চেয়ে বড়ো জানোয়ার, মানুষে গোরুতে সিঙ্গিতে মিশোল, তাকে ওরা বলে গাণ্ডিসাঙ্ডুং, তার কাঁটাওয়ালা জিব দিয়ে চেটে চেটে কতকটা নরম করে আনলে। তার পরে তিনশো লোকের পাতের সামনে দমাদ্দম হামানদিস্তার শব্দ উঠতে লাগল। ওরা বলে, এই ভীষণ শব্দ শুনলেই ওদের জিবে জল আসে; দূর পাড়া থেকে শুনতে পেয়ে ভিখারি আসে দলে দলে। খেতে খেতে যাদের দাঁত ভেঙে যায় তারা সেই ভাঙা দাঁত দান করে যায় বাড়ির কর্তাকে। তিনি সেই ভাঙা দাঁত ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেন জমা ক'রে রাখতে, উইল করে দিয়ে যান ছেলেদের। যার তবিলে যত দাঁত তার তত নাম। অনেকে লুকিয়ে অন্যের সঞ্চিত দাঁত কিনে নিয়ে নিজের ব'লে চালিয়ে দেয়। এই নিয়ে বড়ো বড়ো মকদ্দমা হয়ে গেছে। হাজারদাঁতিরা পঞ্চাশদাঁতির ঘরে মেয়ে দেয় না। একজন সামান্য পনেরোদাঁতি ওদের কেট্কু নাড়ু খেতে গিয়ে হঠাৎ দম আট্কিয়ে মারা গেল, হাজারদাঁতির পাড়ায় তাকে পোড়াবার লোক পাওয়াই গেল না। তাকে লুকিয়ে ভাসিয়ে দিলে চৌচঙ্গি নদীর জলে। তাই নিয়ে নদীর দুই ধারের লোকেরা খেসারতের দাবি করে নালিশ করেছিল, লড়েছিল প্রিভিকৌন্সিল পর্যন্ত।
আমি হাঁপিয়ে উঠে বললুম, থামো, থামো! কিন্তু জিগেস করি, তুমি যে কাহিনীটা আওড়ালে তার বিশেষ গুণটা কী।
ওর গুণটা এই, এটা কুলের আঁঠির চাটনি নয়। যা কিছুই জানি নে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবার শখ মেটালে কোনো নালিশের কারণ থাকে না। কিন্তু, এতেও যে আছে উঁচু দরের হাসি তা আমি বলি নে। বিশ্বাস করবার অতীত যা তাকেও বিশ্বাস করবার যোগ্য করতে পার যদি, তা হলেই অদ্ভুত রসের গল্প জমে। নেহাত বাজারে-চল্তি ছেলে-ভোলাবার সস্তা অত্যুক্তি যদি তুমি বানাতে থাক তা হলে তোমার অপযশ হবে, এই আমি ব'লে রাখলুম।
আমি বললেম, আচ্ছা, এমন করে গল্প বলব যাতে পুপুদিদির বিশ্বাস ভাঙতে ওঝা ডাকতে হবে।
ভালো কথা, কিন্তু লাটসাহেবের বাড়িতে যাওয়া বলতে কী বোঝায়।
বোঝায়, তুমি বিদায় নিলেই ছুটি পাই। একবার বসলে উঠতে চাও না, তাই 'তুমি যাও' অনুরোধটা সামান্য একটু ঘুরিয়ে বলতে হল।
বুঝেছি, আচ্ছা, তবে চললুম।











