লাইব্রেরি থেকে আনাতে দিয়েছি অনোম্যাটোপিইয়া অফ টিণ্টিন্যাব্যুলেশন্। এমন সময় হুড়্মুড়্ করে এসে ঢুকল আমাদের সে।
আমি বললুম, হয়েছে কী, স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়েছে নাকি।
ও বললে নিশ্চয় দিত যদি সে থাকত। কিন্তু,কী কাণ্ড বাধিয়েছে বলো দেখি।
কেন কী হল।
আমাকে নিয়ে এ পর্যন্ত আজগবি গল্প বানিয়েছ। ভাগ্যে আমার নামটা দাও নি, নইলে ভদ্রসমাজে মুখ দেখানো দায় হত। দেখলুম পুপুদিদির মজা লাগছে, তাই সহ্য করেছি সব। কিন্তু এবার যে উল্টো হল।
কেন কী হল বলোই-না।
তবে শোনো। পুপুদিদি কাল গিয়েছিল সিনেমায়। মোটরে উঠতে যাচ্ছে, আমি পিছন থেকে এসে বললুম, দিদিমণি, তোমার গাড়িতে আমাকে তুলে নিয়ে যাও। তার পরে কী আর বলব দাদা, একেবারে হিষ্টিরিয়া।
কিরকম।
হাতে চোখ ঢেকে চেঁচিয়ে উঠে দিদি বললে, যাও যাও, গাঁজাখোরের গা চুরি ক'রে আমার গাড়িতে উঠতে পাবে না। চার দিক থেকে লোক এল ছুটে, আমাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যায় আর- কি। জীবনে অনেক নিন্দে শুনেছি, কিন্তু এরকম ওরিজিন্যাল নিন্দে শুনি নি কখনো। গাঁজাখোরের গা চুরি করা! আমার অতিবড়ো প্রাণের বন্ধুও এমন নিন্দে আমার নামে রটায় নি। বাড়ি ফিরে এসে সমস্ত ব্যাপারটা শোনা গেল। এ তোমারই কীর্তি।
আমারই তো বটে। কী করি বলো। তোমাকে নিয়ে আর কাঁহাতক গল্প বানাই। বয়স হয়ে গেছে, কলমটাকে যেন বাতে ধরল, পুপুদিদির ফরাশমতো অসম্ভব গল্প বলার হাল্কা চাল আর নেই কলমের। তাই এই শেষ গল্পটাতে তোমাকে একেবারে খতম করে দিয়েছি।
খতম হতে রাজি নই, দাদা। দোহাই তোমার, পুপুদিদির ভয় ভাঙিয়ে দাও। বুঝিয়ে বলো, ওটা গল্প।
বলেছিলুম, কিন্তু ভয় ভাঙতে চায় না। নাড়ীতে জড়িয়ে গেছে। উপায় না দেখে স্বয়ং সেই পাতু গেঁজেলকে আনলুম তার সামনে, উল্টো হল ফল। পাতুর গা'খানা প'রে যে তুমিই ঘুরে বেড়াচ্ছ তারই প্রমাণ প্রত্যক্ষ হয়ে গেল।
তা হলে দাদা, গল্পটাকে উল্টিয়ে দাও, ধনুষ্টঙ্কারে মরুক পাতু। গাঁজাখোরের গা'খানাকে নিমতলার ঘাটে পুড়িয়ে ফেলো। ঘটা ক'রে তার শ্রাদ্ধ করব, পুপুদিদিকে করব তাতে নেমন্তন্ন; খরচ যত পড়ে দেব নিজের পকেট থেকে। আমি হলুম দিদির গল্পের বহুরূপী, হঠাৎ এত বড়ো পদ থেকে আমাকে অপদস্থ করলে বাঁচব না।
আচ্ছা, গল্পের উল্টোরথে তোমাকে পুপুদিদির ঘরে আবার ফিরিয়ে আনব।
পরদিন সন্ধ্যার সময় সে এল, আমি শুরু করলুম গল্পটা।--
বললুম,পাতুর স্ত্রী স্বামীর স্বত্ব পাবার জন্যে তোমার নামে আদালতে নালিশ করেছে।
এইটুকু শুনেই সে ব'লে উঠল, এ চলবে না, দাদা। পাতুর স্ত্রীকে তুমি চক্ষে দেখ নি তো। মকদ্দমায় ঐ মহিলাটি যদি জেতে তা হলে যে আসামীপক্ষ আফিম খেয়ে মরবে।
ভয় কী, কথা দিচ্ছি, হার হোক, জিত হোক, টিঁকিয়ে রাখব তোমাকে।
আচ্ছা, ব'লে যাও।
হাত জোড় ক'রে তুমি হাকিমকে বললে, হজুর, ধর্মাবতার, সাত পুরুষে আমি ওর স্বামী নই।
উকিল চোখ রাঙিয়ে বললে, স্বামী নও, তার মানে কী।
তুমি বললে, তার মানে, এ পর্যন্ত আমি ওকে বিয়ে করি নি, দ্বিতীয় আর কোনো মানে আপাতত কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি নে।
রামসদয় মোক্তার খুব একটা ধমক দিয়ে বললে, আলবত তুমি ওর স্বামী, মিথ্যে কথা বোলো না।
তুমি জজসাহেবের দিকে তাকিয়ে বললে, জীবনে বিস্তর মিথ্যে বলেছি, কিন্তু ঐ বুড়িকে সজ্ঞানে স্ব-ইচ্ছায় বিয়ে করেছি, এত বড়ো দিগ্গজ মিথ্যে বানিয়ে বলবার তাকত আমার নেই। মনে করতে বুক কেঁপে ওঠে।
তখন ওরা সাক্ষী তলব করলে পঁয়ত্রিশজন গাঁজাখোরকে। একে একে তারা গাঁজাটেপা আঙুল তোমার মুখে বুলিয়ে বলে গেল, চেহারাটা একেবারে হুবহু পাতুর; এমন কি, বাঁ কপালের আবটা পর্যন্ত। তবে কিনা--
মোক্তার তেরিয়া হয়ে উঠে বললে, 'তবে কিনা' আবার কিসের।
ওরা বললে, সেই রকমের পাতুই বটে, কিন্তু সেই পাতুই, হলপ ক'রে এমন কথা বলি কী ক'রে। ঠাক্রুনকে তো জানি, বন্ধু কম দুঃখ পায় নি, অনেক ঝাঁটা ক্ষয়ে গেছে ওর পিঠে। তার দাম বাঁচালে গাঁজার খরচে টানাটানি পড়ত না। তাই বলছি হজুর, আদালতে হলফ ক'রে ভদ্রলোকের সর্বনাশ করতে পারব না।
মোক্তার চোখ রাঙিয়ে বললে, তা হলে এ লোকটা কে বলো। দ্বিতীয় পাতু বানাবার শক্তি ভগবানেরও নেই।
গেঁজেলের সর্দার বললে, ঠিক বলেছ বাবা, এরকম ছিষ্টি দৈবাৎ হয়। ভগবান নাকে খত দিয়েছেন, এমন কাজ আর করবেন না। তবু তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, একটা কোনো শয়তান ভগবানের পাল্টা জবাব দিয়েছে। একেবারে ওস্তাদের হাতের নকল, পাকা জালিয়াতের কাজ। পাতুর দেহখানা শুকিয়ে শুকিয়ে ওর নাক চিম্সিয়ে বেঁকে গিয়েছিল, সেই বঙ্কিমচন্দুরে নাকটি পর্যন্ত যেন কেটে ওর মুখের মাঝখানে বসিয়ে দিয়েছে। ওর হাতের চামড়া নকল করতে বোধ করি হাজার চামচিকের ডানা খরচ করতে হয়েছে।
তুমি দেখলে মকদ্দমা আর টেঁকে না; সাহেবকে বললে, এক হপ্তা সময় দিন, খাঁটি পাতু পক্ষীরাজকে হাজির ক'রে দেব এই আদালতে।
তখনি ছুটলে তেলিনিপাড়ার দিঘির ঘাটে। কপাল ভালো, ঠিক ঠিক তক্ষুনি তোমার দেহটা উঠছে ভেসে। পাতুর দেহ ডাঙায় চিত ক'রে ফেলে পুরোনো খোলটা জুড়ে বসলে। মস্ত একটা হাঁপ ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাক দিলে, ওরে পাতু!
তখনই ওর দেহটা উঠল খাড়া হয়ে। পাতু বললে, ভায়া, সঙ্গে সঙ্গেই ছিলুম। মনটা অস্থির ছিল গাঁজার মৌতাতে। ইচ্ছে করত, আত্মহত্যে করি, কিন্তু সে রাস্তাও তুমি জুড়ে বসেছিলে। বেঁচে যখন ছিলুম তখন বেঁচে থাকবার শখ ছিল ষোলো-আনা; যেমনি মরেছি অমনি আর যে কোনোমতেই কোনো কালেই মরতে পারব না, এই দুঃখ অসহ্য হয়ে উঠল। সামান্য একটা দড়ি নিয়ে গলায় ফাঁস লাগাব, এটুকু যোগ্যতাও রইল না।
তুমি বললে, যা হবার তা তো হল, এখন চলো আদালতে। জজসাহেবকে ব'লে তোমার গাঁজার বরাদ্দ করে দেব।
গেলে আদালতে। জজসাহেব পাতুকে ধমক দিয়ে বললে, এ বুড়ি তোমার স্ত্রী কি না সত্যি ক'রে বলো।
পাতু বললে, হজুর, সত্যি ক'রে বলতে মন যায় না। কিন্তু ভদ্রলোকের ছেলে মিথ্যে ব'লে পাপ করব কেন। নিশ্চয় জানি যে, পাপের সঙ্গে সঙ্গে উনিই পিছন পিছন ছুটবেন। উনিই আমার প্রথম পক্ষের পরিবার।
সাহেব জিগেস করলেন, আরও আছে না কি।
পাতু বললে, না থাকলে মান রক্ষা হয় না যে। কুলীনের ছেলে। নৈকষ্যকুলীন।
রবিবার দিনে পুপুদিদি পড়েছে গল্পটা। আমাকে জিগেস করলে, আচ্ছা দাদামশায়, তুমি যে লিখেছ একরাশ ইংরেজি বই নিয়ে কোন্ কলেজের জন্যে বই লিখছ। তোমার আবার কলেজ কোথায়, তা ছাড়া কখনো তো দেখি নি ঐরকমের বই খুলতে। তুমি তো লেখ কেবল ছড়া।
স্পষ্ট জবাব না দিয়ে একটুখানি হাসলুম।
আচ্ছা দাদামশায়, তুমি কি সংস্কৃত জান।
দেখো পুপুদিদি, এরকম প্রশ্নগুলো বড়ো রূঢ়। মুখের সামনে জিগেস করতে নেই।











