এল সে তার কাঁটাওয়ালা মোটা গোলাপের গুঁড়ির লাঠিখানা ঠক্ঠক্ করতে করতে। মালকোঁচা-মারা ধুতি, চাদরখানা জড়ানো কোমরে, হাঁটু পর্যন্ত কালো পশমের মোটা মোজা, লাল ডোরা-কাটা জামার উপর হাতাহীন বিলিতি ওয়েস্ট্কোট সবুজ বনাতের, সাদা রোঁয়াওয়ালা রাশিয়ান টুপি মাথায়-- পুরোনো মালের দোকান থেকে কেনা-- বাঁ হাতের আঙুলে ন্যাকড়া জড়ানো-- কোনো একটা সদ্য অপঘাতের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কড়া চামড়ার জুতোর মস্মসানি শোনা যায় গলির মোড় থেকে। ঘন ভুরুদুটোর নীচে চোখদুটো যেন মন্ত্রে-থেমে-যাওয়া দুটো বুলেটের মতো।
বললে, হয়েছে কী। শুকনো মটর চিবোচ্ছিলুম দাঁত শক্ত করবার জন্যে, ছাড়ল না তোমার ঝগড়ু। বললে, বাবুর চোখদুটো ভীষণ লাল হয়েছে, বোধ হয় ডাক্তার ডাকতে হবে। শুনেই তাড়াতাড়ি গয়লাবাড়ি থেকে এক-ভাঁড় চোনা এনেছি; মোচার খোলায় করে ফোঁটা ফোঁটা ঢালতে থাকো, সাফ হয়ে যাবে চোখ।
আমি বললুম, যতক্ষণ তুমি আছ আমার ত্রিসীমানায়, আমার চোখের লাল কিছুতেই ঘুচবে না। ভোরবেলাতেই তোমাদের পাড়ার যত মাতব্বর আমার দরজায় ধন্না দিয়ে পড়েছে।
বিচলিত হবার কী কারণ।
তুমি থাকতে দোসরা কারণের দরকার নেই। খবর পাওয়া গেল, তোমার চেলা কংসারি মুন্সি, যার মুখ দেখলে অযাত্রা,তোমার ছাদে বসে একখানা রামশিঙে তুলে ধরে ফুঁক দিচ্ছে; আর গাঁজার লোভ দেখিয়ে জড়ো করেছ যত ফাটা-গলার ফৌজ, তারা প্রাণপণে চেঁচানি অভ্যেস করছে। ভদ্রলোকেরা বলছে, হয় তারা ছাড়বে পাড়া নয় তোমাকে ছাড়াবে।
মহা উৎসাহে লাফ দিয়ে উঠে সে চীৎকারস্বরে বললে, প্রমাণ হয়েছে!
কিসের প্রমাণ।
বেসুরের দুঃসহ জোর। একেবারে ডাইনামাইট। বদ্সুরের ভিতর থেকে ছাড়া পেয়েছে দুর্জয় বেগ, উড়ে গিয়েছে পাড়ার ঘুম, দৌড় দিয়েছে পাড়ার শান্তি, পালাই-পালাই রব উঠেছে চার দিকে। প্রচণ্ড আসুরিক শক্তি। এর ধাক্কা একদিন টের পেয়েছিলেন স্বর্গের ভালো-মানুষেরা। বসে বসে আধ চোখ বুজে অমৃত খাচ্ছিলেন। গন্ধর্ব ওস্তাদের তম্বুরা ঘাড়ে অতি নিখুঁত স্বরে তান লাগাচ্ছিলেন পরজ-বসন্তে, আর নূপুরঝংকারিণী অপ্সরীরা নিপুণ তালে তেহাই দিয়ে নৃত্য জমিয়েছিলেন। এ দিকে মৃত্যুবরণ নীল অন্ধকারে তিন যুগ ধ'রে অসুরের দল রসাতল-কোঠায় তিমিমাছের লেজের ঝাপ্টার বেলয়ে বেসুর সাধনা করছিল। অবশেষে একদিন শনিতে কলিতে মিলে দিলে সিগ্নাল, এসে পড়ল বেসুর-সংগতের কালাপাহাড়ের দল সুরওয়ালাদের সমে-নাড়া-দেওয়া ঘাড়ে হুংকার ক্রেংকার ঝন্ঝন্কার ধ্রুমকার দুড়ুম্কার গড়্-গড়্গড়ৎকার শব্দে। তীব্র বেসুরের তেলেবেগুনি জ্বলনে পিতামহ-পিতামহ ডাক ছেড়ে তাঁরা লুকোলেন ব্রহ্মাণীর অন্দরমহলে। তোমাকে বলব কী আর, তোমার তো জানা আছে সকল শাস্ত্রই।
জানা যে নেই আজ তা বোঝা গেল তোমার কথা শুনে।
দাদা, তোমাদের বই-পড়া বিদ্যে, আসল খবর কানে পৌঁছয় না। আমি ঘুরে বেড়াই শ্মশানে মশানে, গূঢ়তত্ত্ব পাই সাধকদের কাছ থেকে। আমার উৎকটদন্তী গুরুর মুখকন্দর থেকে বেসুরতত্ত্ব অল্প কিছু জেনেছিলুম, তাঁর পায়ে অনেকদিন ভেরেণ্ডার বিরেচক তৈল মর্দন ক'রে।
বেসুরতত্ত্ব আয়ত্ত করতে তোমার বিলম্ব হয় নি সেটা বুঝতে পারছি। অধিকারভেদ মানি আমি।
দাদা, ঐ তো আমার গর্বের কথা। পুরুষ হয়ে জন্মালেই পুরুষ হয় না, পরুষতার প্রতিভা থাকা চাই। একদিন আমার গুরুর অতি অপূর্ব বিশ্রীমুখ থেকে--
গুরুমুখকে আমরা বলে থাকি শ্রীমুখ, তুমি বললে বিশ্রীমুখ!
গুরুর আদেশ। তিনি বলেন, শ্রীমুখটা নিতান্ত মেয়েলি, বিশ্রী মুখই পুরুষের গৌরব। ওর জোরটা আকর্ষণের নয়, বিপ্রকর্ষণের। মান কি না।
মানতে যে হতভাগ্য বাধ্য হয় সে মানে বই কি।
মধুর রসে তোমার মৌতাত পাকা হয়ে গেছে দাদা, কঠোর সত্য মুখে রোচে না, ভাঙতে হবে তোমাদের দুর্বলতা-- মিঠে সুরে যার নাম দিয়েছ সুরুচি, বিশ্রীকে সহ্য করবার শক্তি নেই যার।
দুর্বলতা ভাঙা সবলতা ভাঙার চেয়ে অনেক শক্ত।--বিশ্রীতত্ত্বর গুরুবাক্য শোনাতে চাচ্ছিলে, শুনিয়ে দাও।
একেবারে আদিপর্ব থেকে গুরু আরম্ভ করলেন ব্যাখ্যান। বললেন, মানবসৃষ্টির শুরুতে চতুর্মুখ তাঁর সামনের দিকের দাড়ি-কামানো দুটো মুখ থেকে মিহি সুর বের করলেন। কোমল রেখাব থেকে মধুর ধারার মসৃণ মিড়ের উপর দিয়ে পিছলে গড়িয়ে এল কোমল নিখাদ পর্যন্ত। সেই সুকুমার স্বরলহরী প্রত্যুষের অরুণবর্ণ মেঘের থেকে প্রতিফলিত হয়ে অত্যন্ত আরামের দোলা লাগালো অতিশয় মিঠে হাওয়ায়। তারই মৃদু হিল্লোল দোলায়িত নৃত্যচ্ছন্দে রূপ নিয়ে দেখা দিল নারী। স্বর্গে শাঁখ বাজাতে লাগলেন বরুণদেবের ঘরনী।
বরুণদেবের ঘরনী কেন।
তিনি যে জলদেবী। নারী জাতটা বিশুদ্ধ জলীয়; তার কাঠিন্য নেই, চাঞ্চল্য আছে, চঞ্চল করেও। ভূব্যবস্থার গোড়াতেই জলরাশি। সেই জলে পানকৌড়ির পিঠে চ'ড়ে যত সব নারী ভেসে বেড়াতে লাগল সারিগান গাইতে গাইতে।
অতি চমৎকার। কিন্তু, তখন পানকৌড়ির সৃষ্টি হয়েছে না কি।
হয়েছে বৈকি। পাখিদের গলাতেই প্রথম সুর বাঁধা চলছিল। দুর্বলতার সঙ্গেই মাধুর্যের অনবচ্ছিন্ন যোগ, এই তত্ত্বটির প্রথম পরীক্ষা হল ঐ দুর্বল জীবগুলির ডানায় এবং কণ্ঠে। একা কথা বলি, রাগ করবে না তো?
না রাগতে চেষ্টা করব।
যুগান্তরে পিতামহ যখন মানবসমাজে দুর্বলতাকেই মহিমান্বিত করবার কাজে কবিসৃষ্টি করেছিলেন, তখন সেই সৃষ্টির ছাঁচ পেয়েছিলেন এই পাখির থেকেই। সেদিন একটা সাহিত্যসম্মিলন গোছের ব্যাপার হল তাঁর সভামণ্ডপে; সভাপতিরূপে কবিদের আহ্বান ক'রে বলে দিলেন, তোমরা মনে মনে উড়তে থাকো শূন্যে, আর ছন্দে ছন্দে গান করো বিনা কারণে, যা-কিছু কঠিন তা তরল হয়ে যাক, যা- কিছু কঠিন তা তরল হয়ে যাক, যা-কিছু বলিষ্ঠ তা এলিয়ে পড়ে যাক আর্দ্র হয়ে।--কবিসম্রাট, আজ পর্যন্ত তুমি তাঁর কথা রক্ষা করে চলেছ।
চলতেই হবে যতদিন না ছাঁচ বদল হয়।
আধুনিক যুগ শুকিয়ে শক্ত হয়ে আসছে, মোমের ছাঁচ আর মিলবেই না। এখন সেদিন নেই যখন নারীদেবতার জলের বাসাটি দোল খেত পদ্মে, যখন মনোহরদুর্বলতায় পৃথিবী ছিল অতলে নিমগ্ন।
সৃষ্টি ঐ মোলায়েমের ছন্দে এসেই থামল না কেন।
গোটা কয়েক যুগ যেতে না যেতেই ধরণীদেবী আর্ত বাক্যে আবেদনপত্র পাঠালেন চতুর্মুখের দরবারে। বললেন, ললনাদের এই লকারবহুল লালিত্য আর তো সহ্য হয় না। স্বয়ং নারীরাই করুণ কল্লোলে ঘোষণা করতে লাগল, ভালো লাগছে না। ঊর্ধ্বলোক থেকে প্রশ্ন এল, কী ভালো লাগছে না। সুকুমারীরা বললে, বলতে পারি নে।--কী চাই।--কী চাই তারও সন্ধান পাচ্ছি নে।
ওদের মধ্যে পাড়াকুঁদুলিরও কি অভিব্যক্তি হয় নি। আগাগোড়াই কি সুবচনীর পালা।
কোঁদলের উপযুক্ত উপলক্ষটি না থাকাতেই বাক্যবাণের টঙ্কার নিমগ্ন রইল অতলে, ঝাঁটার কাঠির অঙ্কুর স্থান পেল না অকূলে।
এত বড়ো দুঃখের চতুর্মুখ লজ্জিত হলেন বোধ করি?
লজ্জা ব'লে লজ্জা! চার মুণ্ড হেঁট হয়ে গেল। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। রাজহংসের কোটি-যোজন-জোড়া ডানাদুটোর 'পরে পুরো একটা ব্রহ্মযুগ। এ দিকে আদিকালের লোকবিশ্রুত সাদ্ধ্বী পরম-পানকৌড়িনী, শুভ্রতায় যিনি ব্রহ্মার পরমহংসের সঙ্গে পাল্লা দেবার সাধনায় হাজার বার ক'রে জলে ডুব দিয়ে দিয়ে চঞ্চুঘর্ষণে পালকগুলোকে ডাঁটাসার ক'রে ফেলছিলেন, তিনি পর্যন্ত ব'লে উঠলেন, নির্মলতাই যেখানে নিরতিশয় সেখানে শুচিতার সর্বপ্রধান সুখটাই বাদ পড়ে, যথা, পরকে খোঁটা দেওয়া; শুদ্ধসত্ত্ব হবার মজাটাই থাকে না। প্রার্থনা করলেন, হে দেব, মলিনতা চাই, ভূরিপরিমাণে, অনতিবিলম্বে এবং প্রবল বেগে। বিধি তখন অস্থির হয়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, ভুল হয়েছে, সংশোধন করতে হবে। বাস্ রে কী গলা। মনে হল মহাদেবের মহাবৃষভটার ঘাড়ে এসে পড়েছে মহাদেবীর মহাসিংহটা-- অতিলৌকিক সিংহনাদে আর বৃষগর্জনে মিলে দ্যুলোকের নীলমণিমণ্ডিত ভিতটাতে দিলে ফাটল ধরিয়ে। মজার আশায় বিষ্ণুলোক থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন নারদ। তাঁর ঢেঁকির পিঠ থাবড়িয়ে বললেন, বাবা ঢেঁকি, শুনে রাখো ভাবীলোকের বিশ্ব-বেসুরের আদিমন্ত্র, যথাকালে ঘর ভাঙাবার কাজে লাগবে। ক্ষুব্ধ ব্রহ্মার চার গলার ঐকতান আওয়াজের সঙ্গে যোগ দিলে দিঙ্নাগেরা শুঁড় তুলে, শব্দের ধাক্কায় দিগঙ্গনাদের বেণীবন্ধ খুলে গিয়ে আকাশ আগাগোড়া ঠাসা হয়ে গেল এলোচুলে--বোধ হল কালো-পাল-তোলা ব্যোমতরী ছুটল কালপুরুষের শ্মশানঘাটে।
হাজার হোক, সৃষ্টিকর্তা পুরুষ তো বটে।
পৌরুষ চাপা রইল না। তাঁর পিছনের দাড়িওয়ালা দুই মুখের চার নাসাফলক উঠল ফুলে, হাঁপিয়ে-ওঠা বিরাট হাপরের মতো। চার নাসারন্ধ্র থেকে একসঙ্গে ঝড় ছুটল আকাশের চার দিককে তাড়না ক'রে। ব্রহ্মাণ্ডে সেই প্রথম ছাড়া পেল দুর্জয়শক্তিমান বেসুরপ্রবাহ-- গোঁ-গোঁ গাঁ-গাঁ হুড়্মুড়্ দুর্দাড়্ গড়্গড়্ ঘড়্ঘড়্ ঘড়াঙ। গন্ধর্বেরা কাঁধে তম্বুরা নিয়ে দলে দলে দৌড় দিল ইন্দ্রলোকের খিড়কির আঙিনায় যেখানে শচীদেবী স্নানান্তে মন্দারকুঞ্জচ্ছায়ায় পারিজাতকেশরের ধূপধূমে চুল শুকোতে যান। ধরণীদেবী ভয়ে কম্পান্বিতা, ইষ্টমন্ত্র জপতে জপতে ভাবতে লাগলেন, ভুল করেছি বা। সেই বেসুরো ঝড়ের উল্টোপাল্টা ধাক্কায় কামানের মুখের তপ্ত গোলার মতো ধক্ধক্ শব্দে বেরিয়ে পড়তে লাগল পুরুষ।-- কী দাদা, চুপচাপ যে। কথাগুলো মনে লাগছে তো?
লাগছে বই কি। একেবারে দুম্দাম্ শব্দে লাগছে।
সৃষ্টির সর্বপ্রধান পর্বে বেসুরেরই রাজত্ব, এ কথাটা বুঝতে পেরেছ তো?
বুঝিয়ে দাও-না।
তরল জলের কোমল একাধিপত্যকে ঢুঁ মেরে, গুঁতো মেরে, লাথি মেরে, কিল মেরে, ঘুষো মেরে, ধাক্কা মেরে, উঠে পড়তে লাগল ডাঙা তার পাথুরে নেড়া মুণ্ডুগুলো তুলে। ভূলোকের ইতিহাসে এইটেকেই সব চেয়ে বড়ো পর্ব ব'লে মান কি না।
মানি বই কি।
এত কাল পরে বিধাতার পৌরুষ প্রকাশ পেল ডাঙায়; পুরুষের স্বাক্ষর পড়ল সৃষ্টির শক্ত জমিতে। গোড়াতেই কী বীভৎস পালোয়ানি। কখনো আগুনে পোড়ানো, কখনো বরফে জমানো, কখনো ভূমিকম্পের জবর্দস্তির যোগে মাটিকে হাঁ করিয়ে কবিরাজি বড়ির মতো পাহাড়গুলোকে গিলিয়ে খাওয়ানো-- এর মধ্যে মেয়েলি কিছু নেই, সে কথা মান কি না।
মানি বই কি।
জলে ওঠে কলধ্বনি, হাওয়ায় বাঁশি বাজে সোঁ-সোঁ-- কিন্তু বিচলিত ডাঙা যখন ডাক পাড়তে থাকে তখন ভরতের সংগীতশাস্ত্রটাকে পিণ্ডি পাকিয়ে দেয়। তোমার মুখ দেখে বোধ হচ্ছে, কথাটা ভালো লাগছে না। কী ভাবছ ব'লেই ফেলো না।
আমি ভাবছি, আর্ট মাত্রেরই একটা পুরাগত বনেদ আছে যাকে বলে ট্র্যাডিশন। তোমার বেসুর- ধ্বনির আর্টকে বনেদি ব'লে প্রমাণ করতে পার কি।
খুব পারি। তোমাদের সুরের মূল ট্র্যাডিশন মেয়ে-দেবতার বাদ্যযন্ত্রে। যদি বেসুরের উদ্ভব খুঁজতে চাও তবে সিধে চলে যাও পৌরাণিক মেয়েমহল পেরিয়ে পুরুষদেবতা জটাধারীর দরজায়। কৈলাসে বীণাযন্ত্র বে-আইনি, ঊর্বশী সেখানে নাচের বায়না নেয় নি। যিনি সেখানে ভীষণ বেতালে তাণ্ডবনৃত্য করেন তাঁর নন্দীভৃঙ্গী ফুঁকতে থাকে শিঙে, তিনি বাজান ববম্বম গালবাদ্য, আর কড়াকড় কড়াকড় ভমরু। ধ্ব'সে পড়তে থাকে কৈলাসের পিণ্ড পিণ্ড পাথর। মহাবেসুরের আদি-উৎপত্তিটা স্পষ্ট হয়েছে তো?
হয়েছে।
মনে রেখো সুরের হার, বেসুরের জিত, এই নিয়েই পালা রচনা হয়েছে পুরাণে দক্ষযজ্ঞের। একদা যজ্ঞসভায় জমা হয়েছিলেন দেবতারা-- দুই কানে কুণ্ডল, দুই বাহুতে অঙ্গদ, গলায় মণিমাল্য। কী বাহার! ঋষিমুনিদের দেহ থেকে আলো পড়ছিল ঠিক্রিয়ে। কণ্ঠ থেকে উঠছিল অনিন্দ্যসুন্দর সুরে সুমধুর সামগান, ত্রিভুবনের শরীর রোমাঞ্চিত। হঠাৎ দুড়্দাড়্ ক'রে এসে পড়ল বিশ্রীরূপের বেসুরি দল, শুচিসুন্দরের সৌকুমার্য মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড। কুশ্রীর কাছে সুশ্রীর হার, বেসুরের কাছে সুরের-- পুরাণে এ কথা কীর্তিত হয়েছে কী আনন্দে, কী অট্টহাস্যে, অন্নদামঙ্গলের পাতা ওল্টালেই তা টের পাবে। এই তো দেখছ বেসুরের শাস্ত্রসম্মত ট্র্যাডিশন। ঐ-যে তুন্দিলতনু গজানন সর্বাগ্রে পেয়ে থাকেন পুজো, এটাই তো চোখ-ভোলানো দুর্বল ললিতকলার বিরুদ্ধে স্থূলতম প্রোটেস্ট্। বর্তমান যুগে ঐ গণেশের শুঁড়ই তো চিম্নি-মূর্তি ধরে পাশ্চাত্য পণ্যযজ্ঞশালায় বৃংহিতধ্বনি করছে। গণনায়কের এই কুৎসিত বেসুরের জোরেই কি ওরা সিদ্ধিলাভ করছে না। চিন্তা করে দেখো।
দেখব।
যখন করবে তখন এ কথাটাও ভেবে দেখো, বেসুরের অজেয় মাহাত্ম্য কঠিন ডাঙাতেই। সিংহ বল', ব্যাঘ্র বল', বলদ বল', যাদের সঙ্গে সগর্বে বীরপুরুষদের তুলনা করা হয় তারা কোনো কালে ওস্তাদজির কাছে গলা সাধে নি। এ কথায় তোমার সন্দেহ আছে কি।
তিলমাত্র না।
এমন কি,ডাঙার অধম পশু যে গর্দভ, যত দুর্বল সে হোক-না, বীণাপাণির আসরে সে সাক্রেদি করতে যায় নি,এ কথা তার শত্রু মিত্র এক বাক্যে স্বীকার করবে।
তা করবে।
ঘোড়া তো পোষমানা জীব-- লাথি মারবার যোগ্য খুর থাকা সত্ত্বেও নির্বিবাদে চাবুক খেয়ে মরে-- তার উচিত ছিল, আস্তাবলে খাড়া দাঁড়িয়ে ঝিঁঝিঁটখাম্বাজ আলাপ করা। তার চিঁহিঁ হিঁহিঁ শব্দে সে রাশি রাশি সফেন চন্দ্রবিন্দুবর্ষণ করে বটে, তবু বেসুরো অনুনাসিকে সে ডাঙার সম্মান রক্ষা করতে ভোলে না। আর গজরাজ, তাঁর কথা বলাই বাহুল্য। পশুপতির কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত এই-সমস্ত স্থলচর জীবের মধ্যে কি একটাও কোকিলকণ্ঠ বের করতে পার। ঐ-যে তোমার বুল্ডগ্ ফ্রেডি চীৎকারে ঘুমছাড়া করে পাড়া, ওর গলায় দয়া ক'রে বা মজা ক'রে বিধাতা যদি দেন শ্যামাদোয়েলের শিষ, ও তা হলে নিজের মধুর কণ্ঠের অসহ্য ধিক্কারে তোমার চল্তি মোটরের তলায় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এ আমি বাজি রাখতে পারি। আচ্ছা, সত্যি করে বলো, কালিঘাটের পাঁঠা যদি কর্কশ ভ্যাভ্যা না করে রামকেলি ভাঁজতে থাকে, তা হলে তুমি তাকে জগন্মাতার পবিত্র মন্দির থেকে দূর-দূর করে খেদিয়ে দেবে না কি।
নিশ্চয় দেব।
তা হলে বুঝতে পারছ আমরা যে সুমহৎ ব্রত নিয়েছি তার সার্থকতা। আমরা শক্ত ডাঙার শাক্ত সন্তান, বেসুরমন্ত্রে দীক্ষিত। আধমরা দেশের চিকিৎসায় প্রয়োগ করতে চাই চরম মুষ্টিযোগ। জাগরণ চাই, বল চাই। জাগরণ শুরু হয়েছে পাড়ায়; প্রতিবেশীদের বলিষ্ঠতা দুম্দাম্ শব্দে দুর্দাম হচ্ছে, পৃষ্ঠদেশে তার প্রমাণ পাচ্ছে আমার চেলারা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোতোয়ালরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে, টনক নড়েছে শাসনকর্তাদের।
তোমার গুরু বলছেন কী।
তিনি মহানন্দে মগ্ন। দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন, বেসুরের নবযুগ এসেছে সমস্ত জগতে। সভ্য জাতরা আজ বলছে, বেসুরটাতেই বাস্তব, ওতেই পুঞ্জীভূত পৌরুষ, সুরের মেয়েমানুষই দুর্বল করেছে সভ্যতা। ওদের শাসনকর্তা বলছে, জোর চাই, খৃস্টানি চাই নে। রাষ্ট্রবিধিতে বেসুর চড়ে যাচ্ছে পর্দায় পর্দায়। সেটা কি তোমার চোখে পড়ে নি, দাদা।
চোখে পড়বার দরকার কী, ভাই। পিঠে পড়ছে দমাদ্দম।
এ দিকে বেতালপঞ্চবিংশতিই চাপল সাহিত্যের ঘাড়ে। আনন্দ করো, বাংলাও ওদের পাছু ধরেছে।
সে তো দেখছি। পাছু ধরতে বাংলা কোনোদিন পিছপাও নয়।
এ দিকে গুরুর আদেশে বেসুরমন্ত্র সাধন করবার জন্যে আমরা হৈহৈসংঘ স্থাপন করেছি। দলে একজন কবি জুটেছে। তার চেহারা দেখে আশা হয়েছিল নবযুগ মূর্তিমান। রচনা দেখে ভুল ভাঙল; দেখি তোমারই চেলা। হাজার বার করে বলছি, ছন্দের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলো গদাঘাতে। বলছি, অর্থমনর্থং ভাবয়নিত্যম্। বুঝিয়ে দিলেম, কথার মানেটাকে সম্মান করায় কেবল দাসবুদ্ধির গাঁঠপড়া মনটাই ধরা পড়ে। ফল হচ্ছে না। বেচারার দোষ নেই--গলদ্ঘর্ম ওঠে, তবু ভদ্রলোকি কাব্যের ছাঁদ ঘোচাতে পারে না। ওকে রেখেছি পরীক্ষাধীনে। প্রথম নমুনা যেটা সমিতির কাছে দাখিল করেছে সেটা শুনিয়ে দিই। সুর দিয়ে শোনাতে পারব না।
সেই জন্যেই তোমাকে ঘরে ঢুকতে দিতে সাহস হয়।
তবে অবধান করো--
পায়ে পড়ি শোনো ভাই গাইয়ে,
হৈহৈপাড়া ছেড়ে দূর দিয়ে যাইয়ে।
হেথা-সা -রে গা-মা পা'য়ে সুরাসুরে যুদ্ধ,
শুদ্ধ কোমলগুলো বেবাক অশুদ্ধ--
অভেদ রাগিণীরাগে ভগিনী ও ভাইয়ে।
তারছেঁড়া তম্বুরা, তালকাটা বাজিয়ে--
দিনরাত বেধে যায় কাজিয়ে।
ঝাঁপতালে দাদ্রায় চৌতালে ধামারে
এলোমেলো ঘা মারে--
তেরে কেটে মেরে কেটে ধাঁ ধাঁ ধাঁ ধাঁ ধাঁইয়ে।
সভাসুদ্ধ একবাক্যে ব'লে উঠলুম, এ চলবে না। এখনো জাতের মায়া ছাড়তে পারে নি--শুচিবায়ুগ্রস্ত, নাড়ী দুর্বল। আমরা বেছন্দ চাই বেপরোয়া। কবির মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া গেল। বললুম, আরও একবার কোমর বেঁধে লাগো, বাঙালি ছেলেদের কানে জোরের কথা হাতুড়ি পিটিয়ে চালিয়ে দাও; মনে রেখো, পিটুনির চোটে ঠেলা মেরে জোর চালানো আজ পৃথিবীর সর্বত্রই প্রচলিত। বাঙালি শুধু কি ঘুমায়ে রয়। দেখলুম, লোকটার অন্তঃকরণ পাক খেয়ে উঠেছে। বলে উঠল, নয় নয়,কখনোই নয়। কলমটাকে কামড়ে ধ'রে ছুটে গিয়ে বসল টেবিলে। করজোড়ে গণেশকে বললে, তোমার কলাবধূকে পাঠিয়ে দাও অন্তঃপুরে, সিদ্ধিদাতা। লাগাও তোমার শুঁড়ের আছাড় আমার মগজে, ভূমিকম্প লাগুক আমার মাতৃভাষায়, জোরের তপ্তপঙ্ক উৎসারিত হোক কলমের মুখে, দুঃশ্রাব্যের চোটে বাঙালির ছেলেকে দিক জাগিয়ে। কবি মিনিট পনেরো পরে বেরিয়ে চীৎকার সুরে আবৃত্তি শুরু করলে। মুখ চোখ লাল, চুলগুলো উস্কোখুস্কো, দশা পাবার দশা।--
মার্ মার্ মার্ রবে মার্ গাঁট্টা,
মারহাট্টা, ওরে মারহাট্টা।
ছুটে আয় দুদ্দাড়,
ভাঙ্ মাথা, ভাঙ্ হাড়,
কোথা তোর বাসা আছে হাড়কাট্টা।
আন্ ঘুষো, আন্ কিল,
আন্ ঢেলা, আন্ ঢিল,
নাক মুখ থেঁতো ক'রে দিক ঠাট্টা।
আগ্ডুম বাগ্ডুম
দুম্দাম ধুমাধুম,
ভেঙে চুরে চুর্মার হোক খাট্টা।
ঘুম যাক,মারো কষে মাল্সাট্টা।
বাঁশিওলা চুপ রাও,
টান মেরে উপ্ড়াও
ধরা হতে ললিতলবঙ্গলতা।
বেল জুঁই চম্পক্
দূরে দিক ঝম্পক,
উপবনে জমা হোক জঙ্গলতা।
আমি অস্থির হয়ে দুই হাত তুলে বললুম, থামো থামো, আর নয়। জয়দেবের ভূত এখনো কাঁধে বসে ছন্দের সার্কাস করছে, কানের দখল ছাড়ে নি। গয়াধামে ঐ লেখাটার যদি পিণ্ডি দিতে চাও তবে ওর উপরে হানো মুষল, ওটাকে ছির্কূটে নাস্তানাবুদ ক'রে তার উপরে ফুট্কি বৃষ্টি করো। কবি হাত জোড় ক'রে বললে, আমি পারব না, তুমি হাত লাগাও। আমি বললুম, ঐ-যে মারহাট্টা শব্দটা তোমার মাথায় এসেছে, ঐটেতেই তোমার ভবিষ্যতের আশা। 'চলন্তিকা' থেকে কথাটাকে ছিঁড়ে ফেলেছ, অর্থের শিকড়টা রয়ে গেল মাটির নীচে। শুধু ডাঁটা ধরে খাড়া রয়েছে ধ্বনির মারমূর্তি। এইবার সমস্তটাকে ছন্নছাড়া করে দিই--দেখো, কী মূর্তি বেরোয়--
হৈ রে হৈ মারহাট্টা
গালপাট্টা
আঁটসাট্টা।
* * *
হাড়কাট্টা ক্যাঁ কোঁ কীঁচ্
গড়্ গড়্ গড়্ গড়্......
হুড়্দ্দুম্ দুদ্দাড়
. . . . .
ডাণ্ডা
ধপাৎ
ঠাণ্ডা
কম্পাউণ্ড ফ্র্যাক্চার
* * *
মড়্ মড়্ মড়্ মড়্
দুড়ুম.......
হুড়্মুড়্ হুড়্মুড়্
দেউকিনন্দন
ঝঞ্ঝন পাণ্ডে
কুন্দন গাড়োয়ান
বাঁকে বিহারী
তড়্বড়্ তড়্বড়্ তড়্বড়্ তড়্বড়্
খট্খট্ মস্মস্
ধড়াধ্বড়
ধড়্ফড়্ ধড়্ফড়্
হো হো হূ হূ হা হা--
ট ঠ ড ঢ ড় ঢ় হঃ--
ইনফর্ণো হেডিস্ লিম্বো।
দাদা, তোমার নকল করি নি, এই সার্টিফিকেট আমাকে দিতে হবে।
খুশি হয়ে দেব।
নবযুগের মহাকাব্য তোমাকে লিখতে হবে, দাদা।
যদি পারি। বিষয়টা কী।
বেসুর-হিড়িম্বের দিগ্বিজয়।
পুপুদিদিকে জিগেস করলুম, কেমন লাগল।
পুপু বললে, ধাঁধা লাগল।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ, সুরাসুরের যুদ্ধে অসুরের জয়টা কেন আমার তেমন খারাপ লাগল না, তাই ভাবছি। বিশ্রী গোঁয়ারটার দিকেই রায় দিতে চাচ্ছে মন।
তার কারণ, তুমি স্ত্রীজাতীয়। অত্যাচারের মোহ কাটে নি। মার খেয়ে আনন্দ পাও, মারবার শক্তিটাকে প্রত্যক্ষ দেখে।
অত্যাচারের আক্রমণ পছন্দসই তা বলতে পারি নে-- কিন্তু বীভৎসমূর্তিতে যে পৌরুষ ঘুষি উঁচিয়ে দাঁড়ায় তাকে মনে হয় সাব্লাইম।
আমার মতটা বলি। দুঃশাসনের আস্ফালনটা পৌরুষ নয়, একেবারে উল্টো। আজ পর্যন্ত পুরুষই সৃষ্টি করেছে সুন্দর, লড়াই করেছে বেসুরের সঙ্গে। অসুর সেই পরিমাণেই জোরের ভান করে যে পরিমাণে পুরুষ হয় কাপুরুষ। আজ পৃথিবীতে তারই প্রমাণ পাচ্ছি।