ওর যেন স্বপ্ন গেল ভেঙে, চমকে উঠল।
জিগেস করলুম, বসে কী ভাবছ ভাই।
ও বললে, শুকসারীর কথা শুনছি।
শুকসারীর দেখা পেলে কোথায়।
ঐ যে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে বন। ডালে ডালে ফুল ছড়াছড়ি-- হল্দে, লাল, নীল, যেন সন্ধ্যাবেলাকার মেঘের মতো। তারই ভিতর থেকে শুকসারীর গলা শোনা যাচ্ছে।
তাদের দেখতে পাচ্ছ তো?
হাঁ, পাচ্ছি। খানিকটা দেখা যায়, খানিকটা ঢাকা।
তা, কী বলছে ওরা।
এইবার মুশকিলে পড়ল আমাদের রাজপুত্তুর। খানিকটা আম্তা আম্তা ক'রে বললে, তুমিই বলো-না, দাদু, ওরা কী বলছে।
ঐ তো পষ্ট শোনা যাচ্ছে ওরা তর্ক করছে।
কিসের তর্ক।
শুক বলছে, আমি এবার উড়ব। সারী বলছে, কোথায় উড়বে। শুক বলছে, যেখানে কোথাও ব'লে কিছুই নেই, কেবল ওড়াই আছে; তুমিও চলো আমার সঙ্গে।
সারী বললে, আমি ভালোবাসি এই বনকে; এখানে ডালে জড়িলে উঠেছে ঝুমকো লতা, এখানে ফল আছে বটের, এখানে শিমুলের ফুল যখন ফোটে তখন কাকের সঙ্গে ঝগড়া ক'রে ভালো লাগে তার মধু খেতে; এখানে রাত্তিরে জোনাকিতে ছেয়ে যায় ঐ কাম্রাঙার ঝোপ, আর বাদলায় বৃষ্টি যখন ঝরতে থাকে তখন দুলতে থাকে নারকেলের ডাল ঝর্ঝর্ শব্দ ক'রে-- আর, তোমার আকাশে কীই বা আছে। শুক বললে, আমার আকাশে আছে সকাল, আছে সন্ধে, আছে মাঝরাত্রের তারা,আছে দক্ষিনে হাওয়ার যাওয়া আসা, আর আছে কিছুই না-- কিছুই না-- কিছুই না।
সুকুমার জিগেস করলে, কিছুই-না থাকে কী ক'রে, দাদু।
সেই কথাই তো এইমাত্র সারী জিগেস করলে শুককে।
শুক কী বলছে।
শুক বলছে, আকাশের সব চেয়ে অমূল্যধন ঐ কিছুই-না। ঐ কিছুই-না আমাকে ডাক দেয় ভোরের বেলায়। ওরই জন্যে আমার মন কেমন করে যখন বনের মধ্যে বাসা বাঁধি। ঐ কিছুই-না কেবল খেলা করে রঙের খেলা নীল আঙিনায়; মাঘের শেষে আমের বোলের নিমন্ত্রণ-চিঠিগুলি ঐ কিছুই-না'র ওড়না বেয়ে হূহু করে উড়ে আসে, মৌমাছিরা খবর পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে।
উৎসাহে সুকুমার লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল; বললে, আমরা পক্ষীরাজকে ঐ কিছুই-না'র রাস্তা দিয়েই তো চালাতে হবে।
নিশ্চয়ই। পুপুদিদির হরণব্যাপারটা আগাগোড়াই ঐ কিছুই-না'র তেপান্তরে।
সুকুমার হাত মুঠো ক'রে বললে, সেইখান দিয়েই আমি তাকে ফিরিয়ে আনব, নিশ্চয় আনব।
বুঝতে পারছ তো, পুপুদিদি?-- রাজপুত্তর তৈরিই আছে, তোমাকে উদ্ধার করতে দেরি হবে না। এতক্ষণে ছাদের উপরে তার ঘোড়াটা একবার পাখা খুলছে, আবার বন্ধ করছে।
তুমি খুব ঝাঁজিয়ে উঠে বললে, দরকার নেই।
বল কী, এত বড়ো বিপদ থেকে তোমার উদ্ধার হল না, আর আমরা নিশ্চিন্ত থাকব?
হয়ে গেছে উদ্ধার।
কখন হল।
শুনলে না? একটু আগেই ঘণ্টাকর্ণ এসে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল।
কখন ঘটল এটা
ঐ-যে, ঢঙ ঢঙ ক'রে দিলে নটা বাজিয়ে।
কোন্ জাতের ঘণ্টাকর্ণ।
হিংস্র জাতের। এখন ইস্কুলে যাবার সময় এগিয়ে আসছে। বিচ্ছিরি লেগেছে আওয়াজটা।
গল্পটা অকালে গেল ভেঙে। দুস্রা রাজপুত্তুর খুঁজে বের করা উচিত ছিল। এ তো অঙ্কের হরণ পূরণ নয়-- ওরকম ক্লাস-পেরোনো ছেলে তেপান্তর পেরোবার স্পর্ধা করবে, এ তুমি কিছুতেই সইতে পারলে না। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলুম,লাখখানেক ঝিঁঝিঁ-পোকা আমদানি করব আমাদের পানাপুকুরের ধারের স্যাওড়াবন থেকে। তারা চাঁদামামার নিদমহলের পশ্চিম দিকের খিড়কির দরজা দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে সবাই মিলে তোমার বিছানার চাদরটাতে দিত টান সুড়্সুড়্ ক'রে। তার উপরে তোমাকে নামিয়ে আনত। তাদের ঝিঁঝিঁ ঝিঁঝিঁ শব্দে চাঁদনি-চকে ঝিমিয়ে পড়ত চাঁদের পাহারাওয়ালা। সমস্ত রাস্তায় বায়না দিয়ে রেখেছিলুম জোনাকির আলোধারীর দলকে। বাঁশতলার বাঁকা গলি দিয়ে তোমাকে নিয়ে চলত, খস্ খস্ শব্দ করতে ঝরে-পড়া শুক্নো পাতাগুলো। ঝর্ ঝর্ করতে থাকত নারকেলের ডাল। গন্ধে-ভুর-ভুর সর্ষেখেতের আল বেয়ে যখন এসে পড়তে তির্পূর্নির ঘাটে তখন ধামা-ভরা বিন্নিধানের খই নিয়ে ডাক দিতুম গঙ্গামায়ের শুঁড়তোলা মকরকে, তোমাকে চড়িয়ে| দিতেম তার পিঠে। ডাইনে বাঁয়ে তার লেজের ঠেলায় জল উঠত কল্কলিয়ে। তিন পহর রাতে শোয়ালগুলো ডাঙায় দাঁড়িয়ে জিগেস করত, ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া! আমি বলতুম, চুপ রও, কুছ নেই হুয়া। এই যাত্রাপথে পেঁচা আর বাদুড়ের সঙ্গেও কিছু আপোষে বন্দোবস্তের কথা ছিল। তাদের কাজে লাগাতুম। ভোর সাড়ে চারটের সময় শুকতারা নেমে পড়ত পশ্চিম-আকাশে, পূর্ব-আকাশে আলোর রেখায় দেখা দিত সকালবেলার তর্জনীতে সোনার আংটি থেকে ঠিক্রে-পড়া সংকেত। সদ্য-জেগে-ওটা কাক তেঁতুলের ডালে বসে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করত, কা-কা? আমি যেমনি বলতুম 'কিচ্ছু না', অমনি দেখতে দেখতে সব যেত মিলিয়ে-- তুমি জেগে উঠতে তোমার বিছানায়।
পুপুদিদি একটুখানি হেসে বললে, এই-যে আমার ছেলেমানুষির কাহিনীটি শোনা গেল-- এটি এত ইনিয়ে-বিনিয়ে ব'লে তোমার কী আনন্দ হল। আমার হিংসুকে স্বভাব ছিল, এইটে জানাবার জন্যে তোমার এতই উৎসাহ! আর, আমাদের বিলিতি-আমড়া গাছের পাকা আমড়াগুলো পেড়ে নিয়ে সুকুমারদাকে লুকিয়ে দিয়ে আসতুম, আমড়া সে ভালোবাসত ব'লে; চুরির অপবাদটা হত আমার, আর ভোগ করত সে-- সে কথাটা চেপে গেছ। সুকুমারদা নাহয় অঙ্কই ভালো কষত, কিন্তু আমার বেশ মনে আছে একদিন সে 'অবধান' কথাটার মানে ভেবে পাচ্ছিল না, আমি স্লেটে লিখে আড় করে ধরে তাকে দেখিয়ে দিয়েছিলুম-- এ কথাগুলো বুঝি তোমার গল্পের মধ্যে পড়ে না?
আমি বললুম, আমার খুশির কারণ এ নয় যে, মনের জ্বালায় তুমি সুকুমারদার যৌবরাজ্য মানতে চাও নি। তার উপরে তোমার হিংসের কারণ ছিল আমার উপর তোমার অনুরাগবশত-- আমার আনন্দের স্মৃতি রয়েছে ঐখানেই।
আচ্ছা, তোমার অহংকার নিয়ে তুমি থাকো। একটা কথা তোমাকে জিগেস করি, সেই-যে তোমার নামহারা বানানো মানুষটি যাকে বলতে সে, তার হল কি।
আমি বললেম, তার বয়স বেড়ে গেছে।
ভালোই তো।
সে এখন চিন্তা করে, মাথায় তার দুঃসমস্যার ভিমরুলে চাক বেঁধেছে, তর্কে তার সঙ্গে পারবার জো নেই।
দেখছি আমারই প্যার৻াল্যাল লাইনেই চলেছে।
তা হতে পারে, কিন্তু গল্পের এলেকা ছাড়িয়ে গেছে। থেকে থেকে সে হাত মুঠো ক'রে ঝেঁকে ঝেঁকে ব'লে উঠছে, শক্ত হতে হবে।
বলুক-না। শক্ত ছাঁদেই গল্প জমুক-না। চুমুক দিয়ে খাওয়া নেই হল, চিবিয়ে খাওয়া চলবে তো। হয়তো আমার পছন্দ হবে।
পাছে আক্কেল দাঁতের অভাবে কায়দা করতে না পার, এই ভয়ে অনেকদিন তাকে চুপ করিয়ে রেখেছি।
ইস! তোমার ভাবনা দেখে হাসি পায়। তুমি ঠাউরে রেখেছ, আমার যথেষ্ট বয়স হয় নি।
সর্বনাশ! এতবড়ো নিন্দে অতিবড়ো শত্রুও করতে পারবে না।
তা হলে ডাকো-না তাকে তোমার আসরে, তার বর্তমান মেজাজটা বুঝে নিই।
তাই সই।