নাতনির ফরমাসে কিছু দিন থেকে লেগেছি মানুষ গড়ার কাজে; নিছক খেলার মানুষ, সত্যমিথ্যের কোনো জবাবদিহি নেই। গল্প যে শুনছে তার বয়স ন বছর, আর যে শোনাচ্ছে সে সত্তর পেরিয়ে গেছে। কাজটা একলাই শুরু করেছিলুম, কিন্তু মালমসলা এতই হাল্কা ওজনের যে, নির্বিচারে পুপুও দিল যোগ। আর-একটা লোককে রেখেছিলুম, তার কথা হবে পরে।
অনেক গল্প শুরু হয়েছে এই ব'লে এক যে ছিল রাজা। আমি আরম্ভ ক'রে দিলুম, এক যে আছে মানুষ। তার পরে লোকে যাকে বলে গপ্পো, এতে তারও কোনো আঁচ নেই। সে মানুষ ঘোড়ায় চ'ড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে গেল না। একদিন রাত্রি দশটার পর এল আমার ঘরে। আমি বই পড়ছিলুম। সে বললে, দাদা, খিদে পেয়েছে।
রাজপুত্তুরের গল্প অনেক শুনেছি; কখনোই তার খিদে পায় না। কিন্তু এর খিদে পেয়ে গেল গোড়াতেই, শুনে খুশি হলুম। খিদে-পাওয়া লোকের সঙ্গে ভাব করা সহজ। খুশি করবার জন্যে গলির মোড়ের থেকে বেশি দূর যেতে হয় না।
দেখলুম, লোকটার দিব্যি খাবার শখ। ফরমাশ করে মুড়োর ঘণ্ট, লাউচিংড়ি, কাঁটাচচ্চড়ি; বড়োবাজারের মালাই পেলে বাটিটা চেঁচেপুঁছে খায়। এক-একদিন শখ যায় আইস্ক্রিমের। এমন ক'রে খায় সে দেখবার যোগ্য। মজুমদারদের জামাইবাবুর সঙ্গে অনেকটা মেলে।
একদিন ঝমাঝম্ বৃষ্টি। বসে বসে ছবি আঁকছি। এখানকার মাঠের ছবি। উত্তর দিকে বরাবর চলে গেছে রাঙা মাটির রাস্তা--দক্ষিণ দিকে পোড়ো জমি, উঁচুনিচু ঢেউ-খেলানো, মাঝে মাঝে ঝাঁকড়া বুনো খেজুর। দূরে দুটো-চারটে তালগাছ আকাশের দিকে কাঙালের মতো তাকিয়ে। তারই পিছনে জমে উঠেছে ঘন মেঘ, যেন একটা প্রকাণ্ড নীল বাঘ ওৎ পেতে আছে, কখন এক লাফে মাঝ-আকাশে উঠে সূর্যটাকে দেবে থাবার ঘা। বাটিতে রঙ গুলে তুলি বাগিয়ে এইসব এঁকে চলেছি।
দরজায় পড়ল ঠেলা। খুলে দেখি ডাকাত নয়, দৈত্য নয়, কোটালের পুত্তুর নয়--সেই লোকটা। সর্বাঙ্গ বেয়ে জল ঝরছে, ময়লা ভিজে জামা গায়ে লেপটে গেছে, কোঁচার ডগায় কাদা, জুতোয় কাদার পিণ্ডি। আমি বললুম, এ কী!
সে বললে, যখন বেরিয়েছিলুম খট্খটে রোদ্দুর। আদ্ধেক পথে আসতে বৃষ্টি নামল। তোমার ঐ বিছানার চাদরটা যদি দাও তো কাপড় ছেড়ে গায়ে জড়িয়ে বসি।
হুকু্ম পাবার সবুর সইল না। চট্ ক'রে খাটের থেকে লক্ষ্ণৌছিটের ঢাকাটা টেনে নিয়ে তাই দিয়ে মাথাটা মুছে কাপড় ছেড়ে সেটা গায়ে জড়িয়ে বসল। ভাগ্যিস কাশ্মীরি, জামিয়ারটা পাতা ছিল না।
বললে, দাদা, তোমাকে একটা গান শোনাব।
কী করি, ছবি-আঁকা বন্ধ করতে হল।
সে শুরু করলে--
ভাবো শ্রীকান্ত নরকান্তকারীরে,
নিতান্ত কৃতান্ত-ভয়ান্ত হবে ভবে।
আমার মুখের ভাব দেখে তার কী সন্দেহ হল জানি নে; জিগেস করলে, কেমন লাগছে।
আমি বললুম, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমাকে গলা সাধতে হবে লোকালয় থেকে দূরে ব'সে। তার পরে বুঝে নেবেন চিত্রগুপ্ত, যদি সইতে পারেন।
সে বললে, পুপেদিদি হিন্দুস্থানি ওস্তাদের কাছে গান শেখে, সেইখানে আমাকে বসিয়ে দিলে কেমন হয়।
আমি বললুম, পুপেদিদিকে যদি রাজি করাতে পার তা হলে কথা নেই।
সে বললে, পুপেদিদিকে আমি বড়ো ভয় করি।
এই পর্যন্ত শুনে আমার শ্রোতা পুপেদিদি খুব হেসে উঠল। তাকে কেউ ভয় করে, এতে সে ভারি খুশি। যেমন খুশি হয় জগতের দোর্দণ্ডপ্রতাপের দল।
দয়াময়ী আশ্বাস দিয়ে বললে, ভয় নেই, আমি তাকে কিছু বলব না।
আমি বললুম, তোমাকে ভয় কে না করে! দুবেলা দু বাটি ক'রে দুধ খাও--গায়ে কী রকম জোর! মনে আছে তো, তোমার হাতে লাঠি দেখে সেই বাঘটা লেজ গুটিয়ে একেবারে নুটুপিসির বিছানার নীচে গিয়ে লুকিয়েছিল।
বীরাঙ্গনা ভারি খুশি। মনে করিয়ে দিলে ভালুকটার কথা-- সে পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল নাবার ঘরের স্নানের জলের টবের মধ্যে।
সেই যে মানুষটার ইতিহাস গড়ে উঠেছিল আমার একলার হাতে এখন থেকে পুপেও তাতে যেখানে-সেখানে জোড়া দিতে লাগল। আমি যদি বা বলি, একদিন বেলা তিনটার সময় সে এসেছিল আমার কাছে দাড়ি কামাবার খুর চেয়ে নিতে, আর নিতে খালি বিস্কুটের টিন, পুপে খবর দেয়, সে ওর কাছ থেকে নিয়ে গেছে পশম বোনবার কুরুশ-কাটি।
সব গল্পেরই একটা আরম্ভ আছে, শেষ আছে, কিন্তু ঐ-যে 'এক যে আছে মানুষ' তার আর শেষ নেই। তার দিদির জ্বর হয়, ডাক্তার ডাকতে যায়। টমি কুকুর আছে, বেড়ালের নখের আঁচড় লেগে তার নাক যায় ছ'ড়ে। পিছন দিক থেকে গোরুর গাড়ির উপর চ'ড়ে বসেছিল, তাই নিয়ে গাড়োয়ানের সঙ্গে হয় বিষম বচসা। উঠোনে কলতলায় পিছলে প'ড়ে বামুন ঠাক্রুনের মাটির ঘড়া দেয় ভেঙে। মোহনবাগানের ফুটবল-ম্যাচ্ দেখতে গিয়েছিল, পকেট থেকে সাড়ে তিন আনা পয়সা কে নেয় তুলে; ফির্তি রাস্তায় ভীমনাগের দোকান থেকে সন্দেশ কেনা বাদ গেল। বন্ধু আছে কিনু চৌধুরী, তার ওখানে গিয়ে কুচো চিংড়ি ভাজা আর আলুর দম ফরমাস করে। এমনি একটার পর একটা চলছে দিনের পর দিন। এর সঙ্গে পুপে জুড়েছে, কোনোদিন দুপুরবেলায় ওর ঘরে গিয়ে বলেছে মায়ের আলমারি থেকে পাকপ্রণালীর বইখানা খুঁজে বের করতে, বন্ধু সুধাকান্তবাবু শিখতে চায় মোচার ঘণ্ট তৈরি করা। আর-একদিন পুপের সুবাসিত নারিকেল তেল নিয়ে গেল চেয়ে, ভয় হয়েছে মাথায় টাক প'ড়ে আসছে দেখে। আর-একদিন দিন্দার ওখানে গান শুনতে গেল, দিন্দা তখন তাকিয়া ঠেসান দিয়ে ঘুমিয়ে।
এই-যে আমাদের এক যে আছে মানুষ, এর একটা নাম নিশ্চয়ই আছে। সে কেবল আমরা দুজনেই জানি, আর-কাউকে বলা বারণ। এইখানটাতেই গল্পের মজা। এক যে ছিল রাজা, তারও নাম নেই; রাজপুত্র, তারও নাম নেই। আর রাজকন্যা, যার চুল লুটিয়ে পড়ে মাটিতে, যার হাসিতে মানিক, চোখের জলে মুক্তো, তারও নাম কেউ জানে না। ওরা নামজাদা নয়, অথচ ঘরে ঘরে ওদের খ্যাতি।
এই-যে আমাদের মানুষটি, একে আমরা শুধু বলি 'সে'। বাইরের লোক কেউ নাম জিগেস করলে আমরা দুজনে মুখ-চাওয়া-চাওয়ি ক'রে হাসি। পুপে বলে, আন্দাজ ক'রে বলো দেখি, প দিয়ে আরম্ভ। কেউ বলে প্রিয়নাথ, কেউ বলে পঞ্চানন, কেউ বলে পাঁচকড়ি, কেউ বলে পীতাম্বর, কেউ বলে পরেশ, কেউ বলে পীটাস্, কেউ বলে প্রেস্কট, কেউ বলে পীরবক্স, কেউ বলে পীয়ার খাঁ।
এইখানে এসে কলম থামতেই একজন বললে, গল্প চলবে তো?
কার গল্প। এ তো রাজপুত্তুর নয়, এ হল মানুষ, এ খায়-দায় ঘুমোয়, আপিসে যায়, সিনেমা দেখবারও শখ আছে। দিনের পর দিন যা সবাই করছে তাই এর গল্প। মনের মধ্যে যদি মানুষটাকে স্পষ্ট ক'রে গ'ড়ে তোল তা হলে দেখতে পাবে, এ যখন দোকানের রোয়াকে ব'সে রসগোল্লা খায় আর তার রস ঠোঙার ছিদ্র দিয়ে অজানিতে পড়তে থাকে তার ময়লা ধুতির উপর, সেটাই গল্প। যদি জিগেস কর 'তার পরে' তা হলে বলব, তার পরে ও ট্রামে চড়ে বসল, হঠাৎ জ্ঞান হল পয়সা নেই, টপ্ ক'রে লাফিয়ে পড়ল। তার পরে? তার পরে এই রকমই আরও কত কী--বড়োবাজার থেকে বহুবাজার, বহুবাজার থেকে নিমতলা।
ওদের মধ্যে একজন বললে, যা সৃষ্টিছাড়া, বড়োবাজারে বহুবাজারে, এমন কি নিমতলাতেও যার গতি নেই, তা নিয়ে কি গল্প হয় না।
আমি বললুম, যদি হয় তা হলেই হয়, না হলে হয়ই না।
সে বললে, হোক তবে। হোক-না একেবারে যা ইচ্ছে তাই; মাথা নেই, মুণ্ডু নেই, মানে নেই, মোদ্দা নেই এমন একটা-কিছু।
এটা হল স্পর্ধা। বিধাতার সৃষ্টি, নিয়মের রসারসি দিয়ে ক'ষে বাঁধা, যেটা হবার সেটা হবেই। এ তো সহ্য হয় না। একঘেয়ে বিধানের সৃষ্টিকর্তা পিতামহকে এমন ক্ষেত্রে ঠাট্টা ক'রে নেওয়া যাক যেখানে শাস্তির ভয় নেই। এ তো তাঁর নিজের এলেকা নয়।
আমাদের সে ছিল কোণে বসে। কানে কানে বললে, দাদা, লেগে যাও। আমার নাম দিয়ে যা-খুশি চালিয়ে দিতে পার, ফৌজদারি করব না।
সে মানুষটির পরিচয় দেওয়ার দরকার আছে।
পুপুদিদিমণিকে ধারা বেয়ে যে গল্প ব'লে যাচ্ছি সেই গল্পের মূল অবলম্বন হচ্ছে একটি সর্বনামধারী সে, কেবলমাত্র বাক্য দিয়ে তৈরি। সেইজন্যে একে নিয়ে যা-তা করা সম্ভব, কোনোখানে এসে কোনো প্রশ্নের হুঁচোট খাবার আশঙ্কা নেই। কিন্তু অনাসৃষ্টির চাক্ষুষ প্রমাণ দেবার জন্যে একজন শরীরধারী জোগাড় করতে হয়েছে। সাহিত্যের মামলায় কেস্টা যখনই বড়ো বেশি বেসামাল হয়ে পড়ে তখনই এ লোকটা সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। কিছুই বাধে না। আমার মতো মোক্তারের ইশারা পেলেই সে অম্লানমুখে বলতে পারে যে, কাঁচড়াপাড়ার কুম্ভমেলায় গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে কুমীরে ধরেছিল তার টিকির ডগা। সেটা গেল তলিয়ে, বোঁটা-ছেঁড়া মানবদেহের বাকি অংশটুকু উঠে এসেছে ডাঙায়। আরও একটু টিপে দিলে সে নির্লজ্জ হয়ে বলতে পারে, মানোয়ারী জাহাজের ডুবুরি গোরা সাত মাস পাঁক ঘেঁটে গোটা পাঁচ-ছয় চুল ছাড়া বাকি টিকিটা উদ্ধার করে এনেছে, বকশিষ পেয়েছে এককালীন সোয়া তিন টাকা। পুপুদিদি তবু যদি বলে 'তার পরে' তা হলে তখনি শুরু করবে, নীলরতন ডাক্তারের পায়ে ধরে বললে, দোহাই ডাক্তারবাবু, ওষুধ দিয়ে টিকিটা জোড়া দিয়ে লাগিয়ে দাও, নইলে তেলোর কাছে প্রসাদী ফুল বাঁধতে পারছি নে। তিনি সন্ন্যাসী-দত্ত বজ্রজটী মলম লাগিয়ে টিকিটা একেবারে মরিয়া হয়ে বেড়ে চলেছে, অফুরান একটা কেঁচোর মতো। পাগড়ি পরলে পাগড়িটা বেলুনের মতো ফেঁপে উঠতে থাকে, মাথার বালিশটার উপর চুড়ো তৈরি হতে থাকে দৈত্যপুরীর ব্যাঙের ছাতার মতো। বাঁধা মাইনে দিয়ে নাপিত রাখতে হল। প্রহরে প্রহরে তাকে দিয়ে ব্রহ্মতালু চাঁচিয়ে নিতে হচ্ছে।
তবু যদি শ্রোতার কৌতূহল না মেটে তা হলে সে করুণ মুখ ক'রে বলতে থাকে যে, মেডিক্যাল কলেজের সার্জন-জেনেরাল হাতের আস্তিন গুটিয়ে বসে ছিল; তার ভীষণ জেদ, মাথার ঐ জায়গাটাতে ইস্ক্রুপ দিয়ে ফুটো ক'রে সেইখানে রবারের ছিপি এঁটে গালা লাগিয়ে শিলমোহর ক'রে দেবে, ইহকাল-পরকালে ওখান দিয়ে আর টিকি গজাতে পারবে না। চিকিৎসাটা ইহকাল ডিঙিয়ে পরকালেই গিয়ে ঠেকবে, এই আশঙ্কায় ও কোনোমতেই রাজি হল না।
আমাদের এই 'সে' পদার্থটি ক্ষণজন্মা বটে; এমনতরো কোটিকে গোটিক মেলে। মিথ্যে কথা বানাতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভা। আমার আজগবি গল্পের এত বড়ো উত্তরসাধক ওস্তাদ বহু ভাগ্যে জুটেছে। গল্প-প্রশ্নের উত্তরপাড়ার এই যে মানুষ, মাঝে মাঝে একে পুপুদিদির কাছে এনে হাজির করি-- দেখে তার বড়ো চোখ আরও বড়ো হয়ে ওঠে। খুশি হয়ে বাজার থেকে গরম জিলিপি এনে খাইয়ে দেয়।-- লোকটা অসম্ভব জিলিপি ভালোবাসে, আর ভালোবাসে শিকদারপাড়া গলির চম্চম্। পুপুদিদি জিগেস করে, তোমার বাড়ি কোথায়। ও বলে, কোন্নগরে, প্রশ্নচিহ্নের গলিতে।
নাম বলি নে কেন। নাম বললে ইনি যে কেবলমাত্র ইনিতেই এসে ঠেকবেন, এই ভয়। জগতে আমি আছি একজন মাত্র, তুমিও তাই, সেই তুমি আমি ছাড়া আর-সকলেই তো সে। আমার গল্পের সকল সে'র উনি জামিন।
একটা কথা ব'লে রাখি, নইলে অধর্ম হবে। ওকে মাঝে রেখে যে পালা জমানো হয়েছে তার থেকে যারা বিচার করে তারা ভুল করে; যারা তাকে চাক্ষুষ দেখেছে তারা জানে লোকটা সুপুরুষ, চেহারা সুগম্ভীর। রাত্তিরে যেমন তারার আলোর ছড়াছড়ি, ওর গাম্ভীর্য তেমনি চাপা হাসিতে ভরা। ও পয়লা নম্বরের মানুষ তাই কোনো ঠাট্টা-মস্করায় ওকে জখম করতে পারে না। ওকে বোকার মতো সাজাতে আমার মজা লাগে, কেননা ও আমার চেয়ে বুদ্ধিমান। অবুঝের ভান করলেও ওর মানহানি হয় না; সুবিধে হয়, পুপুর স্বভাবের সঙ্গে ওর মিল হয়ে যায়।











