ঘর

শিবচরণ নিমাই নিবারণ ও চন্দ্রকান্ত

ঘর

শিবচরণ নিমাই নিবারণ ও চন্দ্রকান্ত

চন্দ্রকান্ত।

সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে।

শিবচরণ।

কী হল বলো দেখি।

চন্দ্রকান্ত।

ললিতের সঙ্গে কাদম্বিনীর বিবাহ স্থির হয়ে গেল।

নিবারণ।

সে কী! সে যে বিবাহ করবে না শুনলুম ?

চন্দ্রকান্ত।

সে তো স্ত্রীকে বিবাহ করছে না। তার টাকা বিয়ে করে টাকাটি সঙ্গে নিয়ে বিলেত যাবে। যা হোক, এখন আর-একবার আমাদের নিমাইবাবুর মত নেওয়া উচিত-- ইতিমধ্যে যদি আবার বদল হয়ে থাকে।

শিবচরণ।

(ব্যস্তভাবে) না না, আর মত বদলাতে সময় দেওয়া হবে না। তার পূর্বেই আমরা পাঁচ জনে পড়ে কোনো গতিকে ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে হচ্ছে। চলো নিমাই, অনেক আয়োজন করবার আছে। (নিবারণের প্রতি) তবে চললেম ভাই।

নিবারণ।

এসো।

[ নিমাই ও শিবচরণের প্রস্থান

চন্দরবাবু, আপনার তো খাওয়া হল না, কেবল ঘুরে ঘুরেই অস্থির হলেন--একটু বসুন, আপনার জন্যে জলখাবারের আয়োজন করে আসি গে।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

ক্ষান্তমণির প্রবেশ

ক্ষান্তমণির প্রবেশ

ক্ষান্তমণি।

এখন বাড়ি যেতে হবে? না কী।

চন্দ্রকান্ত।

(দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া) নাঃ, আমি এখানে বেশ আছি।

ক্ষান্তমণি।

তা তো দেখতে পাচ্ছি। তা, চিরকাল এইখানেই কাটাবে না কি।

চন্দ্রকান্ত।

বিনুর সঙ্গে আমার তো সেইরকমই কথা হয়েছে।

ক্ষান্তমণি।

বিনু, তোমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কিনা, বিনুর সঙ্গে কথা হয়েছে! এখন ঢের হয়েছে, চলো।

চন্দ্রকান্ত।

(জিব কাটিয়া মাথা নাড়িয়া) সে কি হয়! বন্ধুমানুষকে কথা দিয়েছি এখন কি সে ভাঙতে পারি।

ক্ষান্তমণি।

আমার ঘাট হয়েছে, আমাকে মাপ করো তুমি। আমি আর কখনো বাপের বাড়ি গিয়ে থাকব না। তা, তোমার তো অযত্ন হয়নি--আমি তো সেখান থেকে সমস্ত রেঁধে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।

চন্দ্রকান্ত।

বড়োবউ, আমি কি তোমার রান্নার জন্যে তোমাকে বিয়ে করেছিলুম। যে বৎসর তোমার সঙ্গে অভাগার শুভবিবাহ হয় সে বৎসর কলকাতা শহরে কি রাঁধুনি বামুনের মড়ক হয়েছিল।

ক্ষান্তমণি।

আমি বলছি, আমার একশ বার ঘাট হয়েছে, আমাকে মাপ করো--আমি আর কখনো এমন কাজ করব না। এখন তুমি ঘরে চলো।

চন্দ্রকান্ত।

তবে একটু রোসো। নিবারণবাবু আমার জলখাবারের ব্যবস্থা করতে গেছেন-উপস্থত ত্যাগ করে যাওয়াটা শাস্ত্রবিরুদ্ধ।

ক্ষান্তমণি।

আমি সেখানে সব ঠিক করে রেখেছি, তুমি এখনি চলো।

চন্দ্রকান্ত।

বল কী, নিবারণবাবু--

ক্ষান্তমণি।

সে আমি নিবারণবাবুকে বলে পাঠাব এখন, তুমি চলো।

চন্দ্রকান্ত।

তবে চলো। সকল গোরুগুলিই তো একে একে গোষ্ঠে গেল। আমিও যাই।

বন্ধুগণ।

(নেপথ্য হইতে) চন্দরদা।

ক্ষান্তমণি।

ওই রে, আবার ওরা আসছে ! ওদের হাতে পড়লে আর তোমার রক্ষে নেই।

চন্দ্রকান্ত।

ওদের হাতে তুমি আমি দু-জনেই পড়ার চেয়ে একজন পড়া ভালো। শাস্ত্রে লিখছে "সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ', অতএব এ স্থলে আমার অর্ধাঙ্গের সরাই ভালো।

ক্ষান্তমণি।

তোমার ঐ বন্ধুগুলোর জ্বালায় আমি কি মাথামোড় খুঁড়ে মরব।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

বিনোদবিহারী নিমাই ও নলিনাক্ষের প্রবেশ

বিনোদবিহারী নিমাই ও নলিনাক্ষের প্রবেশ

চন্দ্রকান্ত।

কেমন মনে হচ্ছে বিনু?

বিনোদবিহারী।

সে আর কী বলব দাদা।

চন্দ্রকান্ত।

নিমাই, তোর স্নায়ুরোগের বর্তমান লক্ষণটা কী বল্‌ দেখি।

নিমাই।

অত্যন্ত সাংঘাতিক। ইচ্ছে করছে দিগ্বিদিকে নেচে বেড়াই।

চন্দ্রকান্ত।

ভাই, নাচতে হয় তো দিকে নেচো, আবার বিদিকে নেচো না। পূর্বে তোমার যে রকম দিগ্‌ভ্রম হয়েছিল--কোথায় মির্জাপুর আর কোথায় বাগবাজার!

নিমাই।

এখন তোমার খবরটা কী চন্দরদা।

চন্দ্রকান্ত।

আমি কিছু দ্বিধায় পড়ে গেছি। এখানেও আহার তৈরি হচ্ছে ঘরেও আহার প্রস্তুত-- কিন্তু ঘরের দিকে ডবল টান পড়েছে।

নলিনাক্ষ।

বিনু, এই মরুজগৎ তোমার কাছে তো আবার নন্দনকানন হয়ে উঠল--তুমি তো ভাই সুখী হলে--

চন্দ্রকান্ত।

সেজন্যে ওকে আর লজ্জা দিসনে নলিন, সে ওর দোষ নয়। সুখী না হবার জন্যে ও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, এমন কি, প্রায় সম্পূর্ণ কৃতকার্য হয়েছিল; এমন সময় বিধাতা ওর সঙ্গে লাগলেন--নিতান্ত ওকে কানে ধরে সুখী করে দিলেন। সেজন্যে ওকে মাপ করতে হবে।

বিনোদবিহারী।

দেখ্‌ নলিন, তুই আমাকে ত্যাগ কর্‌। দুধের সাধ আর ঘোলে মেটাসনে। তুইও একটা বিয়ে করে ফেল্‌--আর এই জগৎটাকে শখের মরুভূমি করে রাখিসনে।

চন্দ্রকান্ত।

একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, নলিন, জীবনে আর কখনো ঘটকালি করব না-- আজ তোর খাতিরে সে প্রতিজ্ঞা আমি এখনি ভঙ্গ করতে প্রস্তুত আছি।

নিমাই।

এখনি?

চন্দ্রকান্ত।

হাঁ এখনি। এক বার কেবল বাড়ি থেকে চাদরটা বদলে আসতে হবে।

নিমাই।

সেই কথাটা খুলে বলো। আর এ পর্যন্ত তোমার প্রতিজ্ঞা যে কী রকম রক্ষা করে এসেছ সে আর প্রকাশ করে কাজ নেই।

বিনোদবিহারী।

নলিন, আমার গা ছুঁয়ে বল্‌ দেখি তুই বিয়ে করবি।

নলিনাক্ষ।

তুমি যদি বল বিনু, তা হলে আমি নিশ্চয় করব। এ পর্যস্ত আমি তোমার কোন্‌ অনুরোধটা রাখিনি বলো।

বিনোদবিহারী।

চন্দরদা, তবে আর কী! একটা খোঁজ করো। একটি সৎকায়স্থর মেয়ে। ওঁদের আবার একটু সুবিধে আছে--খাদ্যের সঙ্গে হজমিগুলিটুকু পান, রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্বের জোগাড় হয়।

চন্দ্রকান্ত।

তা বেশ কথা। আমি এই সংসারসমুদ্রে দিব্যি একটি খেয়া জমিয়েছি--একে একে তোদের দুটিকে আইবুড়ো-কূল থেকে বিবাহ-কূলে পার করে দিয়েছি--মিস্টার চাটুজ্যেকেও একহাঁটু কাদার মধ্যে নাবিয়ে দিয়ে এসেছি, এখন আর কে কে যাত্রী আছে ডাক দাও--

বিনোদবিহারী।

এখন এই অনাথ যুবকটিকে পার করে দাও।

নলিনাক্ষ।

বিনু ভাই, আর কেউ নয়, কেবল তুমি যাকে পছন্দ করে দেবে, আমি তাকেই নেব। দেখেছি তোমার সঙ্গে আমার রুচির মিল হয়।

বিনোদবিহারী।

তাই সই। তবে আমি সন্ধানে বেরোব। চন্দরদার আবার চাদর বদলাতে বড়ো বিলম্ব হয় দেখেছি। ততক্ষণ আমিই খেয়া দেব।

নিমাই।

আজ তবে সভাভঙ্গ হোক। ও দিকে যতই রাত বয়ে যাচ্ছে আমাদের চন্দ্র ততই ম্লান হয়ে আসছেন।

চন্দ্রকান্ত।

উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু আগে আমাদের ভাগ্যলক্ষ্মীদের একটি বন্দনা গেয়ে তার পরে বেরোনো যাবে। এটি বিরহকালে আমার নিজের রচনা--বিরহ না হলে গান বাঁধবার অবসর পাওয়া যায় না। মিলনের সময় মিলনটা নিয়েই কিছু ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়।

গান। প্রথমে চন্দ্র পরে সকলে মিলিয়া

বাউলের সুর

গান। প্রথমে চন্দ্র পরে সকলে মিলিয়া

বাউলের সুর

যার অদৃষ্টে যেমনি জুটুক তোমরা সবাই ভালো!

আমাদের এই আঁধার ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালো।

কেউ বা অতি জ্বলজ্বল, কেউ বা ম্লান ছলছল

কেউ বা কিছু দহন করে, কেউ বা স্নিগ্ধ আলো।

নূতন প্রেমে নূতন বধূ, আগাগোড়া কেবল মধু,

পুরাতনে অম্লমধুর একটুকু ঝাঁঝালো।

বাক্য যখন বিদায় করে চক্ষু এসে পায়ে ধরে,

রাগের সঙ্গে অনুরাগে সমান ভাগে ঢালো।

আমরা তৃষ্ণা তোমরা সুধা, তোমার তৃপ্তি আমরা ক্ষুধা,

তোমার কথা বলতে কবির কথা ফুরালো।

যে মূর্তি নয়নে জাগে সবই আমার ভালো লাগে--

কেউ বা দিব্যি গৌরবরন, কেউ বা দিব্যি কালো।
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6