অন্তঃপুর
সুদর্শনা।
যুদ্ধ এখনো চলছে?
সুরঙ্গমা।
হাঁ, এখনো চলছে।
সুদর্শনা।
যুদ্ধে যাবার পূর্বে বাবা এসে বললেন, তুই একজনের হাত থেকে ছেড়ে এসে আজ সাতজনকে টেনে আনলি। ইচ্ছে করছে, তোকে সাত টুকরো করে ওদের সাতজনের মধ্যে ভাগ করে দিই। সত্যিই যদি তাই করতেন, ভালো হত। সুরঙ্গমা!
সুরঙ্গমা।
কী মা!
সুদর্শনা।
তোর রাজার যদি রক্ষা করবার শক্তি থাকত তা হলে আজ তিনি কি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারতেন।
সুরঙ্গমা।
মা, আমাকে কেন বলছ। আমার রাজার হয়ে উত্তর দেবার শক্তি কি আমার আছে। উত্তর যদি দেন তো নিজেই এমনি করে দেবেন যে, কারো বুঝতে কিছু বাকি থাকবে না। যদি না দেন তা হলে সকলকেই নির্বাক্ হয়ে থাকতে হবে। আমি কিছুই বুঝি নে জানি, সেইজন্যে কোনোদিন তাঁর বিচার করি নে।
সুদর্শনা।
যুদ্ধে কে কে যোগ দিয়েছে বল্ তো।
সুরঙ্গমা।
সাতজন রাজাই যোগ দিয়েছে।
সুদর্শনা।
আর কেউ না?
সুরঙ্গমা।
সুবর্ণ যুদ্ধের পূর্বেই গোপনে পালাবার চেষ্টা করছিল-- কাঞ্চীরাজ তাকে শিবিরে বন্দী করে রেখেছেন।
সুদর্শনা।
আমার মৃত্যুই ভালো ছিল। কিন্তু রাজা, রাজা, আমার পিতাকে রক্ষা করবার জন্যে যদি আসতে তা হলে তোমার যশ বাড়ত বৈ কমত না। আমার অপরাধে তিনি শাস্তি পান কেন?
সুরঙ্গমা।
সংসারে আমরা তো কেউ একলা নই মা, ভালোমন্দ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়-- সেইজন্যেই ভয়, নইলে একলার জন্যে ভয় কিসের।
সুদর্শনা।
দেখ্ সুরঙ্গমা, আমি যখন থেকে এখানে এসেছি কতবার হঠাৎ মনে হয়েছে, আমার জানলার নীচে থেকে যেন বীণা বাজছে।
সুরঙ্গমা।
তা হবে, কেউ হয়তো বাজায়।
সুদর্শনা।
সেখানটা ঘন বন, অন্ধকার,মাথা বাড়িয়ে কতবার দেখতে চেষ্টা করি, ভালো করে কিছু দেখতে পাই নে।
সুরঙ্গমা।
হয়তো কোনো পথিক ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে আর বাজায়।
সুদর্শনা।
তা হবে। কিন্তু আমার মনে পড়ে আমার সেই বাতায়নটি। সন্ধ্যার সময় সেজে এসে আমি সেখানে দাঁড়াতুম আর আমাদের সেই দীপ-নেবানো বাসরঘরের অন্ধকার থেকে গানের পার গান, তানের পর তান ফোয়ারার মুখের ধারার মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার সামনে এসে যেন নানা লীলায় ঝরে ঝরে পড়ত। সেই গানই তো কোন্ অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে কোন্ অন্ধকারের দিকে আমাকে ডেকে নিয়ে যেত।
সুরঙ্গমা।
আহা মা,সে কী অন্ধকার! সেই অন্ধকারের দাসী আমি।
সুদর্শনা।
আমার জন্যে সেখান থেকে তুই কেন এলি।
সুরঙ্গমা।
আমার রাজা আবার হাতে ধরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন, এই আদরটুকু পাবার জন্যে।
সুদর্শনা।
না না, তিনি আসবেন না। তিনি আমাদের একবারে ছেড়ে দিয়েছেন। কেনই বা না ছাড়বেন। অপরাধ তো কম করি নি।
সুরঙ্গমা।
যদি ছেড়ে দিতেই পারেন তা হলে তাঁকে আর দরকার নেই, তা হলে তিনি নেই, তা হলে আমার সেই অন্ধকার একেবারে শূন্য-- তার মধ্যে থেকে বীণা বাজে নি, কেউ ডাকে নি-- সমস্ত বঞ্চনা।
দ্বারীর প্রবেশ
দ্বারীর প্রবেশ
সুদর্শনা।
কে তুমি।
দ্বারী।
আমি এই প্রাসাদের দ্বারী।
সুদর্শনা।
কী খবর, শীঘ্র বলো।
দ্বারী।
আমাদের মহারাজ বন্দী হয়েছেন।
সুদর্শনা।
বন্দী হয়েছেন! মা গো বসুন্ধরা!
[ মূর্ছা
[ মূর্ছা