অন্তঃপুর
সুদর্শনা।
যা যা সুরঙ্গমা, তুই যা! আমার মধ্যে একটা রাগের আগুন জ্বলছে-- আমি কাউকে সহ্য করতে পারছি নে। তুই অমন শান্ত হয়ে থাকিস, ওতে আমার আরো রাগ হয়।
সুরঙ্গমা।
কার উপর রাগ করছ মা!
সুদর্শনা।
সে আমি জানি নে, কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে-- সমস্ত ছারখার হয়ে যাক! অতবড়ো রানীর পদ এক মুহূর্তে বিসর্জন দিয়ে এলুম, সে কি এমনি কোণে লুকিয়ে ঘর ঝাঁট দেবার জন্যে। মশাল জ্বলে উঠবে না? ধরণী কেঁপে উঠবে না? আমার পতন কি শিউলি ফুলের খসে পড়া। সে কি নক্ষত্রের পতনের মতো অগ্নিময় হয়ে দিগন্তকে বিদীর্ণ করে দেবে না।
সুরঙ্গমা।
দাবানল জ্বলে ওঠবার আগে গুমরে গুমরে ধোঁওয়ায়-- এখনো সময় যায় নি।
সুদর্শনা।
রানীর মহিমা ধূলিসাৎ করে দিয়ে বাইরে চলে এলুম, এখানে আর কেউ নেই যে আমার সঙ্গে মিলবে? একলা-- একলা আমি! আমার এতবড়ো ত্যাগ গ্রহণ করে নেবার জন্যে কেউ এক পা'ও বাড়াবে না?
সুরঙ্গমা।
একলা তুমি না-- একলা না।
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা, তোর কাছে সত্যি করে বলছি, আমাকে পাবার জন্যে প্রাসাদে আগুন লাগিয়েছিল, এতেও আমি রাগ করতে পারি নি-- ভিতরে ভিতরে আনন্দে আমার বুক কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এতবড়ো অপরাধ! এতবড়ো সাহস! সেই সাহসেই আমার সাহস জাগিয়ে দিলে, সেই আনন্দেই আমার সমস্ত ফেলে দিয়ে আসতে পারলুম। কিন্তু সে কি কেবল আমার কল্পনা! আজ কোথাও তার চিহ্ন দেখি না কেন।
সুরঙ্গমা।
তুমি যার কথা মনে ভাবছ সে তো আগুন লাগায় নি, আগুন লাগিয়েছিল কাঞ্চীরাজ।
সুদর্শনা।
ভীরু! ভীরু! অমন মনোমোহন রূপ-- তার ভিতরে মানুষ নেই। এমন অপদার্থের জন্যে নিজেকে এতবড়ো বঞ্চনা করেছি? লজ্জা! লজ্জা! কিন্তু সুরঙ্গমা, তোর রাজার কি উচিত ছিল না আমাকে এখনো ফেরাবার জন্যে আসে। (সুরঙ্গমা নিরুত্তর) তুই ভাবছিস, ফেরবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি! কখনো না। রাজা এলেও আমি ফিরতুম না। কিন্তু সে একবার বারণও করলে না! চলে যাবার দ্বার একেবারে খোলা রইল! বাইরের নিরাবরণ রাস্তা রানী বলে আমার জন্যে একটু বেদনা বোধ করলে না? সেও তোর রাজার মতোই কঠিন? দীনতম পথের ভিক্ষুকও তার কাছে যেমন আমিও তেমনি! চুপ করে রইলি যে। বল্-না, তোর রাজার এ কিরকম ব্যবহার!
সুরঙ্গমা।
সে তো সবাই জানে-- আমার রাজা নিষ্ঠুর, কঠিন, তাকে কি কেউ কোনোদিন টলাতে পারে।
সুদর্শনা।
তবে তুই তাকে দিনরাত্রি এমন ডাকিস কেন।
সুরঙ্গমা।
সে যেন এইরকম পর্বতের মতোই চিরদিন কঠিন থাকে-- আমার কান্নায়, আমার ভাবনায় সে যেন টল্মল্ না করে। আমার দুঃখ আমারই থাক্, সেই কঠিনেরই জয় হোক।
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা, দেখ্ তো, ঐ মাঠের পারে পূর্বদিগন্তে যেন ধুলো উড়ছে।
সুরঙ্গমা।
হাঁ, তাই তো দেখছি।
সুদর্শনা।
ঐ-যে, রথের ধ্বজার মতো দেখাচ্ছে না?
সুরঙ্গমা।
হাঁ, ধ্বজাই তো বটে।
সুদর্শনা।
তবে তো আসছে! তবে তো এল!
সুরঙ্গমা।
কে আসছে।
সুদর্শনা।
আবার কে! তোর রাজা। থাকতে পারবে কেন। এতদিন চুপ করে আছে এই আশ্চর্য।
সুরঙ্গমা।
না, এ আমার রাজা নয়।
সুদর্শনা।
না বৈকি! তুমি তো সব জান! ভারি কঠিন তোমার রাজা! কিছুতেই টলেন না! দেখি কেমন না টলেন। আমি জানতুম সে ছুটে আসবে। কিন্তু মনে রাখিস সুরঙ্গমা, আমি তাকে একদিনের জন্যেও ডাকি নি। আমার কাছে তোমার রাজা কেমন করে হার মানে এবার দেখে নিয়ো। সুরঙ্গমা, যা একবার বেরিয়ে গিয়ে দেখে আয় গে। (সুরঙ্গমার প্রস্থান) রাজা এসে আমাকে ডাকলেই বুঝি যাব? কখনো না। আমি যাব না, যাব না।
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমা।
মা, এ আমার রাজা নয়।
সুদর্শনা।
নয়? তুই সত্যি বলছিস? এখনো আমাকে নিতে এল না?
সুরঙ্গমা।
না, আমার রাজা এমন করে ধুলো উড়িয়ে আসে না। সে কখন আসে কেউ টেরই পায় না।
সুদর্শনা।
এ বুঝি তবে--
সুরঙ্গমা।
কাঞ্চীরাজের সঙ্গে সে'ই আসছে।
সুদর্শনা।
তার নাম কী জানিস।
সুরঙ্গমা।
তার নাম সুবর্ণ।
সুদর্শনা।
তবে তো সে আসছে। ভেবেছিলুম, আবর্জনার মতো বুঝি বাইরে এসে পড়েছি, কেউ নেবে না-- কিন্তু আমার বীর তো আমাকে উদ্ধার করতে আসছে। সুবর্ণকে তুই জানতিস?
সুরঙ্গমা।
যখন বাপের বাড়ি ছিলুম তখন সে জুয়োখেলার দলে--
সুদর্শনা।
না না, তোর মুখে আমি তার কোনো কথা শুনতে চাই নে। সে আমার বীর, সে আমার পরিত্রাণকর্তা। তার পরিচয় আমি নিজেই পাব। কিন্তু সুরঙ্গমা, তোর রাজা কেমন বল্ তো। এত হীনতা থেকেও আমাকে উদ্ধার করতে এল না? আমার আর দোষ দিতে পারবি নে। আমি এখানে দিনরাত্রি দাসীগিরি করে তার জন্যে চিরজীবন অপেক্ষা করে থাকতে পারব না। তোর মতো দীনতা করা আমার দ্বারা হবে না। আচ্ছা, সত্যি বল্, তুই তোর রাজাকে খুব ভালোবাসিস?
সুরঙ্গমার গান
সুরঙ্গমার গান
আমি কেবল তোমার দাসী।
কেমন করে আনব মুখে তোমায় ভালোবাসি!
গুণ যদি মোর থাকত তবে
অনেক আদর মিলত ভবে,
বিনামূল্যের কেনা আমি শ্রীচরণপ্রয়াসী॥