সুদর্শনা ও সুরঙ্গমা
বাতায়ন
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমা
সুদর্শনা।
তা হলে স্বয়ংবরসভায় আমাকে যেতেই হবে? নইলে পিতার প্রাণরক্ষা হবে না?
সুরঙ্গমা।
কাঞ্চীরাজ তো এইরকম বলেছেন।
সুদর্শনা।
এই কি রাজার উচিত কথা। তিনি কি নিজের মুখে বলেছেন?
সুরঙ্গমা।
না,তাঁর দূত সুবর্ণ এসে জানিয়ে গেছে।
সুদর্শনা।
ধিক্,ধিক্ আমাকে।
সুরঙ্গমা।
সেইসঙ্গে কতকগুলি শুকনো ফুল দিয়ে আমাকে বললে, তোমার রানীকে বোলো, বসন্ত-উৎসবের এই স্মৃতিচিহ্ন বাইরে যত মলিন হয়ে আসছে অন্তরে ততই নবীন হয়ে বিকশিত হচ্ছে।
সুদর্শনা।
চুপ কর্, চুপ কর্, আমাকে আর দগ্ধ করিস নে।
সুরঙ্গমা।
ঐ দেখো, সভায় রাজারা সব বসেছেন। ঐ যাঁর গায়ে কোনো আভরণ নেই, কেবল মুকুটে একটি ফুলের মালা জড়ানো, উনিই হচ্ছেন কাঞ্চীর রাজা। সুবর্ণ তাঁর পিছনে ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
সুদর্শনা।
ঐ সুবর্ণ! তুই সত্যি বলছিস?
সুরঙ্গমা।
হাঁ মা, আমি সত্যি বলছি।
সুদর্শনা।
ওকেই আমি সেদিন দেখেছিলুম? না, না। সে আমি আলোতে অন্ধকারে বাতাসে গন্ধেতে মিলে আর-একটা কী দেখেছিলুম? ও নয়, ও নয়।
সুরঙ্গমা।
সকলে তো বলে, ওকে চোখে দেখতে সুন্দর।
সুদর্শনা।
ঐ সুন্দরেও মন ভোলে! আমার এ পাপ-চোখকে কী দিয়ে ধুলে এর গ্লানি চলে যাবে।
সুরঙ্গমা।
সেই কালোর মধ্যে ডুবিয়ে ধুতে হবে-- সেই আমার রাজার সকল-রূপ-ডোবানো রূপের মধ্যে। রূপের কালি যা-কিছু চোখে লেগেছে সব যাবে।
সুদর্শনা।
কিন্তু সুরঙ্গমা, এমন ভুলেও মানুষ ভোলে কেন।
সুরঙ্গমা।
ভুল ভাঙবে বলে ভোলে।
প্রতিহারী।
(প্রবেশ করিয়া) স্বয়ংবরসভায় রাজারা অপেক্ষা করে আছেন।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
সুদর্শনা।
সুরঙ্গমা, আমার অবগুণ্ঠনের চাদরখানা নিয়ে আয় গে।
[ সুরঙ্গমার প্রস্থান
রাজা, আমার রাজা! তুমি আমাকে ত্যাগ করেছ, উচিত বিচারই করেছ। কিন্তু আমার অন্তরের কথা কি তুমি জানবে না। (বুকের বসনের ভিতর হইতে ছুরিকা বাহির করিয়া) দেহে আমার কলুষ লেগেছে, এ দেহ আজ আমি সবার সমক্ষে ধুলোয় লুটিয়ে যাব। কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে আমার দাগ লাগে নি-- বুক চিরে সেটা কি তোমাকে আজ জানিয়ে যেতে পারব না। তোমার সেই মিলনের অন্ধকার ঘরটি আমার হৃদয়ের ভিতরে আজ শূন্য হয়ে রয়েছে-- সেখানকার দরজা কেউ খোলে নি প্রভু। সে কি খুলতে তুমি আর আসবে না। তবে দ্বারের কাছে তোমার বীণা আর বাজবে না? তবে আসুক মৃত্যু, আসুক-- সে তোমার মতোই কালো, তোমার মতোই সুন্দর, তোমার মতোই সে মন হরণ করতে জানে। সে তুমিই, সে তুমি।
গান
এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে,
ওহে অন্ধকারের স্বামী!
এসো নিবিড়, এসো গভীর, এসো জীবনপারে,
আমার চিত্তে এসো নামি।
এ দেহমন মিলায়ে যাক, হইয়া যাক হারা,
ওহে অন্ধকারের স্বামী!
বাসনা মোর, বিকৃতি মোর, আমার ইচ্ছাধারা
ওই চরণে যাক থামি।
নির্বাসনে বাঁধা আছি দুর্বাসনার ডোরে,
ওহে অন্ধকারের স্বামী।
সব বাঁধনে তোমার সাথে বন্দী করো মোরে,
ওহে, আমি বাঁধনকামী।
আমার প্রিয়, আমার শ্রেয়, আমার হে পরম,
ওহে অন্ধকারের স্বামী--
সকল ঝ'রে সকল ভ'রে আসুক সে চরম,
ওগো, মরুক-না এই আমি॥