রাজগণ
স্বয়ংবরসভা
রাজগণ
বিদর্ভ।
ওহে কাঞ্চীরাজ, তোমার অঙ্গে যে কোনো আভরণ রাখ নি।
কাঞ্চী।
কোনো আশা নেই ব'লে। আভরণে যে পরাভবকে দ্বিগুণ লজ্জা দেবে।
কলিঙ্গ।
যত আভরণ সমস্তই ছত্রধরের অঙ্গে দেখছি।
বিরাট।
এর দ্বারা কাঞ্চীরাজ বাহ্য শোভার হীনতা প্রচার করতে চান। নিজের দেহে ওঁর পৌরুষের অভিমান অন্য কোনো আভরণ রাখতেই দেয় নি।
কোশল।
ওঁর কৌশল জানি, সমস্ত আভরণধারীদের মাঝখানে উনি আভরণ-বর্জনের দ্বারাই নিজের মহিমা প্রমাণ করতে চান।
পাঞ্চাল।
সেটা কি উনি ভালো করছেন। সকলেই জানে, রমণীর চোখ পতঙ্গের মতো-- আভরণের দীপ্তিতে সকলের আগে ছুটে এসে পড়ে।
কলিঙ্গ।
কিন্তু, আর কত বিলম্ব হবে।
কাঞ্চী।
অধীর হবেন না কলিঙ্গরাজ, বিলম্বেই ফল মধুর হয়ে দেখা দেয়।
কলিঙ্গ।
ফল নিশ্চয় পাব জানলে বিলম্ব সইত। ভোগের আশা অনিশ্চিত, তাই দর্শনের আশায় উৎসুক আছি।
কাঞ্চী।
আপনার নবীন যৌবন, এ বয়সে বারংবার আশাকে ত্যাগ করলেও সে প্রগল্ভা নারীর মতো ফিরে ফিরে আসে-- আমাদের আর সেদিন নেই।
কলিঙ্গ।
কিন্তু শুভলগ্নযে উত্তীর্ণ হয়ে যায়!
কাঞ্চী।
ভয় নেই, শুভগ্রহও দুর্লভ দর্শনের জন্যে অপেক্ষা করবে। যদি নির্বোধ নাও করে তবে প্রিয়দর্শনে অশুভগ্রহেরও দৃষ্টি প্রসন্ন হয়ে উঠবে।
বিদর্ভ।
বিরাটরাজ, আপনি যাত্রা করেছিলেন কবে।
বিরাট।
সুসময় দেখেই বেরিয়েছিলুম। দৈবজ্ঞ বলেছিল, যাত্রা সফল হবেই।
পাঞ্চাল।
আমরা সকলেই তো শুভযোগ দেখে বেরিয়েছি, কিন্তু কৃপণ বিধাতা তো একটি বৈ ফল রাখেন নি।
কোশল।
এই ফলটি ত্যাগ করানোই হয়তো শুভগ্রহের কাজ।
কাঞ্চী।
এ কী উদাসীনের মতো কথা বলছ কোশলরাজ! ফল ত্যাগ করাবার জন্যে এত আয়োজনের কী দরকার ছিল।
কোশল।
ছিল বৈকি। কামনা না করে তো ত্যাগ করা যায় না। কাঞ্চীরাজ, আমাদের আসনগুলো যেন কেঁপে উঠল। এ কি ভূমিকম্প নাকি।
কাঞ্চী।
ভূমিকম্প? তা হবে।
বিদর্ভ।
কিম্বা হয়তো আর-কোনো রাজার সৈন্যদল এসে পড়ল।
কলিঙ্গ।
তা হতে পারে, কিন্তু তা হলে তো দূতের মুখে সংবাদ পাওয়া যেত।
বিদর্ভ।
আমার কাছে এটা কিন্তু দুর্লক্ষণ বলে মনে হচ্ছে।
কাঞ্চী।
ভয়ের চক্ষে সব লক্ষণই দুর্লক্ষণ।
বিদর্ভ।
অদৃষ্টপুরুষকে ভয় করি, সেখানে বীরত্ব খাটে না।
পাঞ্চাল।
বিদর্ভরাজ, আজকেকার শুভকার্যে দ্বিধা জন্মিয়ে দিয়ো না।
কাঞ্চী।
অদৃষ্ট যখন দৃষ্ট হবেন তখন তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করে যাবে।
বিদর্ভ।
তখন হয়তো সময় থাকবে না। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, যেন একটা--
কাঞ্চী।
ঐ "যেন একটা'র কথা তুলবেন না-- ওটা আমাদেরই সৃষ্টি, অথচ আমাদেরই বিনাশ করে।
কলিঙ্গ।
বাইরে বাজনা বাজছে নাকি।
পাঞ্চাল।
বাজনা বলেই বোধ হচ্ছে।
কাঞ্চী।
তবে আর কী, নিশ্চয়ই রানী সুদর্শনা। বিধাতা এতক্ষণ পরে আমাদের ভাগ্যফল নিয়ে আসছেন-- এ তাঁরই পায়ের শব্দ। (জনান্তিকে) সুবর্ণ,অমনতরো সংকুচিত হয়ে আমার আড়ালে আপনাকে লুকিয়ে রেখো না। তোমার হাতে আমার রাজছত্র কাঁপছে যে।
যোদ্ধৃবেশে ঠাকুরদার প্রবেশ
যোদ্ধৃবেশে ঠাকুরদার প্রবেশ
কলিঙ্গ।
ও কী ও! ও কে!
পাঞ্চাল।
বিনা আহ্বানে প্রবেশ করে লোকটা কে হে।
বিরাট।
স্পর্ধা তো কম নয়! কলিঙ্গরাজ, তুমি একে রোধ করো।
কলিঙ্গ।
আপনারা বয়োজ্যেষ্ঠ থাকতে আমার অগ্রসর হওয়া অশোভন হবে।
বিদর্ভ।
শোনা যাক-না কী বলে।
ঠাকুরদা।
রাজা এসেছেন।
বিদর্ভ।
(সচকিত হইয়া) রাজা!
পাঞ্চাল।
কোন্ রাজা।
কলিঙ্গ।
কোথাকার রাজা।
ঠাকুরদা।
আমার রাজা।
বিরাট।
তোমার রাজা।
কলিঙ্গ।
কে।
কোশল।
কে সে।
ঠাকুরদা।
আপনারা সকলেই জানেন তিনি কে। তিনি এসেছেন।
বিদর্ভ।
এসেছেন?
কোশল।
কী তাঁর অভিপ্রায়।
ঠাকুরদা।
তিনি আপনাদের আহ্বান করেছেন।
কাঞ্চী।
ইস্! আহ্বান! কীভাবে আহ্বান করেছেন।
ঠাকুরদা।
তাঁর আহ্বান যিনি যেভাবে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করেন বাধা নেই-- সকলপ্রকার অভ্যর্থনাই প্রস্তুত আছে।
বিরাট।
তুমি কে।
ঠাকুরদা।
আমি তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে একজন।
কাঞ্চী।
সেনাপতি? মিথ্যে কথা। ভয় দেখাতে এসেছ? তুমি মনে করেছ তোমার ছদ্মবেশ আমার কাছে ধরা পড়ে নি? তোমাকে বিলক্ষণ চিনি। তুমি আবার সেনাপতি!
ঠাকুরদা।
আপনি আমাকে ঠিক চিনেছেন। আমার মতো অক্ষম কে আছে।
তবু আমাকেই আজ তিনি সেনাপতির বেশ পরিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন-- বড়ো বড়ো বীরদের ঘরে বসিয়ে রেখেছেন।
কাঞ্চী।
আচ্ছা, উপযুক্ত সমারোহে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাব-- কিন্তু উপস্থিত একটা কাজ আছে, সেটা শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে।
ঠাকুরদা।
যখন তিনি আহ্বান করেন তখন তিনি আর অপেক্ষা করেন না।
কোশল।
আমি তাঁর আহ্বান স্বীকার করছি। এখনই যাব।
বিদর্ভ।
কাঞ্চীরাজ, অপেক্ষা করার কথাটা ভালো ঠেকছে না। আমি চললুম।
কলিঙ্গ।
আপনি প্রবীণ, আমরা আপনারই অনুসরণ করব।
পাঞ্চাল।
ওহে কাঞ্চীরাজ, পিছনে চেয়ে দেখো, তোমার রাজছত্র ধুলায় লুটোচ্ছে; তোমার ছত্রধর কখন পালিয়েছে জানতেও পার নি।
কাঞ্চী।
আচ্ছা, আমিও যাচ্ছি রাজদূত! কিন্তু সভায় নয়, রণক্ষেত্রে।
ঠাকুরদা।
রণক্ষেত্রেই আমার প্রভুর সঙ্গে আপনার পরিচয় হবে, সেও অতি উত্তম প্রশস্ত স্থান।
বিরাট।
ওহে, আমরা সকলে হয়তো কাল্পনিক ভয়ে ভঙ্গ দিচ্ছি-- শেষকালে দেখছি একা কাঞ্চীরাজেরই জিত হবে।
পাঞ্চাল।
তা হতে পারে। ফলটা প্রায় হাতের কাছে এসেছে, এখন ভীরুতা করে সেটা ফেলে যাওয়া ভালো হচ্ছে না।
কলিঙ্গ।
কাঞ্চীর সঙ্গে যোগ দেওয়াই শ্রেয়। ও যখন এতটা সাহস করছে তখন ও কি কিছু বিবেচনা না করেই করছে।