সুদর্শনা ও সুরঙ্গমা
পথ
সুদর্শনা ও সুরঙ্গমা
সুদর্শনা।
বেঁচেছি, বেঁচেছি সুরঙ্গমা! হার মেনে তবে বেঁচেছি। ওরে বাস্ রে! কী কঠিন অভিমান! কিছুতেই গলতে চায় না। আমার রাজা কেন আমার কাছে আসতে যাবে, আমিই তাঁর কাছে যাব, এই কথাটা কোনোমতেই মনকে বলাতে পারছিলুম না। সমস্ত রাতটা সেই জানালায় পড়ে ধুলোয় লুটিয়ে কেঁদেছি, দক্ষিনে হাওয়া বুকের বেদনার মতো হুহু করে বয়েছে, আর কৃষ্ঞচতুর্দশীর অন্ধকারে বউ-কথা-কও চার পহর রাত কেবলই ডেকেছে-- সে যেন অন্ধকারের কান্না।
সুরঙ্গমা।
আহা, কালকের রাতটা মনে হয়েছিল যেন কিছুতেই আর পোহাতে চায় না।
সুদর্শনা।
কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি নে, তারই মধ্যে বার বার আমার মনে হচ্ছিল, কোথায় তার বীণা বাজছিল। যে নিষ্ঠুর তার কঠিন হাতে কি অমন মিনতির সুর বাজে। বাইরের লোক আমার অসম্মানটাই দেখে গেল, কিন্তু গোপন রাত্রের সেই সুরটা কেবল আমার হৃদয় ছাড়া আর তো কেউ শুনল না। সে বীণা তুই কি শুনেছিলি সুরঙ্গমা! না, সে আমার স্বপ্ন?
সুরঙ্গমা।
সেই বীণা শুনব বলেই তো তোমার কাছে কাছে আছি। অভিমান-গলানো সুর বাজবে জেনেই কান পেতে পড়ে ছিলুম।
সুদর্শনা।
তার পণটাই রইল, পথে বের করলে তবে ছাড়লে। মিলন হলে এই কথাটাই তাকে বলব যে, আমিই এসেছি, তোমার আসার অপেক্ষা করি নি। বলব, চোখের জল ফেলতে ফেলতে এসেছি, কঠিন পথ ভাঙতে ভাঙতে এসেছি। এ গর্ব আমি ছাড়ব না।
সুরঙ্গমা।
কিন্তু সে গর্বও তোমার টিকবে না। সে যে তোমারও আগে এসেছিল, নইলে তোমাকে বের করে কার সাধ্য।
সুদর্শনা।
তা হয়তো এসেছিল। আভাস পেয়েছিলুম, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নি। যতক্ষণ অভিমান করে বসে ছিলুম ততক্ষণ মনে হয়েছিল, সেও আমাকে ছেড়ে গিয়েছে। অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে যখনই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম তখনই মনে হল-- সেও বেরিয়ে এসেছে, রাস্তা থেকেই তাকে পাওয়া শুরু করেছি। এখন আমার মনে আর কোনো ভাবনা নেই। তার জন্যে এত যে দুঃখ, এই দুঃখই আমাকে তার সঙ্গ দিচ্ছে। এত কষ্টের রাস্তা আমার পায়ের তলায় যেন সুরে সুরে বেজে উঠছে। এ যেন আমার বীণা, আমার দুঃখের বীণা-- এরই বেদনার গানে তিনি এই কঠিন পাথরে এই শুকনো ধুলোয় আপনি বেরিয়ে এসেছেন, আমার হাত ধরেছেন-- সেই আমার অন্ধকার ঘরের মধ্যে যেমন করে হাত ধরতেন-- হঠাৎ চমকে উঠে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত-- এও সেইরকম। কে বললে তিনি নেই! সুরঙ্গমা, তুই কি বুঝতে পারছিস নে তিনি লুকিয়ে এসেছেন?
সুরঙ্গমার গান
অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে।
কখন তুমি এলে, হে নাথ, মৃদুচরণপাতে।
ভেবেছিলেম, জীবনস্বামী
তোমায় বুঝি হারাই আমি--
আমায় তুমি হারাবে না বুঝেছি আজ রাতে।
যে নিশীথে আপন হাতে নিবিয়ে দিলেম আলো
তারই মাঝে তুমি তোমার ধ্রুবতারা জ্বালো
তোমার পথে চলা যখন
ঘুচে গেল, দেখি তখন--
আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে॥
সুদর্শনা।
ও কে ও! চেয়ে দেখ্ সুরঙ্গমা, এত রাত্রে এই আঁধার পথে আরো একজন পথিক বেরিয়েছে যে!
সুরঙ্গমা।
মা, এ যে কাঞ্চীর রাজা দেখছি।
সুদর্শনা।
কাঞ্চীর রাজা?
সুরঙ্গমা।
ভয় কোরো না মা!
সুদর্শনা।
ভয়! ভয় কেন করব। ভয়ের দিন আমার আর নেই।
কাঞ্চীরাজ। (প্রবেশ করিয়া) মা, তুমিও চলেছ বুঝি? আমিও এই এক পথেরই পথিক। আমাকে কিছুমাত্র ভয় কোরো না।
সুদর্শনা।
ভালোই হয়েছে কাঞ্চীরাজ, আমরা দুজনে তাঁর কাছে পাশাপাশি চলেছি, এ ঠিক হয়েছে। ঘর ছেড়ে বেরোবার মুখেই তোমার সঙ্গে আমার যোগ হয়েছিল, আজ ঘরে ফেরবার পথে সেই যোগই যে এমন শুভযোগ হয়ে উঠবে তা আগে কে মনে করতে পারত।
কাঞ্চী।
কিন্তু মা, তুমি যে হেঁটে চলেছ এ তো তোমাকে শোভা পায় না। যদি অনুমতি কর তা হলে এখনই রথ আনিয়ে দিতে পারি।
সুদর্শনা।
না না, অমন কথা বোলো না-- যে পথ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে এসেছি সেই পথের সমস্ত ধুলোটা পা দিয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে ফিরব, তবেই আমার বেরিয়ে আসা সার্থক হবে। রথে করে নিয়ে গেলে আমাকে ফাঁকি দেওয়া হবে।
সুরঙ্গমা।
মহারাজ, তুমিও তো আজ ধুলোয়। এ পথে তো হাতি ঘোড়া রথ কারো দেখি নি।
সুদর্শনা।
যখন রানী ছিলুম তখন কেবল সোনারূপোর মধ্যেই পা ফেলেছি, আজ তাঁর ধুলোর মধ্যে চলে আমার সেই ভাগ্যদোষ খণ্ডিয়ে নেব। আজ আমার সেই ধুলোমাটির রাজার সঙ্গে পদে পদে এই ধুলোমাটিতে মিলন হচ্ছে-- এ সুখের খবর কে জানত।
সুরঙ্গমা।
রানীমা, ঐ দেখো, পূর্ব দিকে চেয়ে দেখো, ভোর হয়ে আসছে। আর দেরি নেই মা-- তাঁর প্রাসাদের সোনার চূড়ার শিখর দেখা যাচ্ছে।
গান
ভোর হল বিভাবরী, পথ হল অবসান।
শুন ওই লোকে লোকে উঠে আলোকেরই গান।
ধন্য হলি ওরে পান্থ,
রজনী জাগরক্লান্ত,
ধন্য হল মরি মরি ধুলায় ধূসর প্রাণ।
বনের কোলের কাছে
সমীরণ জাগিয়াছে।
মধুভিক্ষু সারে সারে
আগত কুঞ্জের দ্বারে।
হল তব যাত্রা সারা,
মোছ মোছ অশ্রুধারা,
লজ্জাভয় গেল ঝরি, ঘুচিল রে অভিমান॥
ঠাকুরদার প্রবেশ
ঠাকুরদার প্রবেশ
ঠাকুরদা।
ভোর হল দিদি, ভোর হল।
সুদর্শনা।
তোমাদের আশীর্বাদে পৌঁচেছি ঠাকুরদা, পৌঁচেছি।
ঠাকুরদা।
কিন্তু আমাদের রাজার রকম দেখেছ? রথ নেই, বাদ্য নেই, সমারোহ নেই।
সুদর্শনা।
বল কী, সমরোহ নেই? ঐ-যে আকাশ একেবারে রাঙা, ফুলগন্ধের অভ্যর্থনায় বাতাস একেবারে পরিপূর্ণ।
ঠাকুরদা।
তা হোক। আমাদের রাজা যত নিষ্ঠুর হোক, আমরা তো তেমন কঠিন হতে পারি নে-- আমাদের যে ব্যথা লাগে। এই দীনবেশে তুমি রাজভবনে যাচ্ছ, এ কি আমরা সহ্য করতে পারি। একটু দাঁড়াও, আমি ছুটে গিয়ে তোমার রানীর বেশটা নিয়ে আসি।
সুদর্শনা।
না না না! সে রানীর বেশ তিনি আমাকে চিরদিনের মতো ছাড়িয়েছেন, সবার সামনে আমাকে দাসীর বেশ পরিয়েছেন-- বেঁচেছি, বেঁচেছি। আমি আজ তাঁর দাসী-- যে-কেউ তাঁর আছে, আমি আজ সকলের নীচে।
ঠাকুরদা।
শত্রুপক্ষ তোমার এ দশা দেখে পরিহাস করবে সেইটে আমাদের অসহ্য হয়।
সুদর্শনা।
শত্রুপক্ষের পরিহাস অক্ষয় হোক, তারা আমার গায়ে ধুলো দিক। আজকের দিনের অভিসারে সেই ধুলোই যে আমার অঙ্গরাগ।
ঠাকুরদা।
এর উপরে আর কথা নেই। এখন আমাদের বসন্ত-উৎসবের শেষ খেলাটাই চলুক-- ফুলের রেণু এখন থাক্, দক্ষিনে হাওয়ায় এবার ধুলো উড়িয়ে দিক। সকলে মিলে আজ ধূসর হয়ে প্রভুর কাছে যাব। গিয়ে দেখব তার গায়েও ধুলো মাখা। তাকে বুঝি কেউ ছাড়ে মনে করছ? যে পায়, তার গায়ে মুঠো মুঠো ধুলো দেয় যে! সে ধুলো সে ঝেড়েও ফেলে না।
কাঞ্চী।
ঠাকুরদা, তোমাদের এই ধুলোর খেলায় আমাকে ভুলো না। আমার এই রাজবেশটাকে এমনি মাটি করে নিয়ে যেতে হবে যাতে একে আর চেনা না যায়।
ঠাকুরদা।
সে আর দেরি হবে না ভাই! যেখানে নেবে এসেছ এখানে যত তোমার মিথ্যে মান সব ঘুচে গেছে, এখন দেখতে দেখতে রঙ ফিরে যাবে। আর, এই আমাদের রানীকে দেখো-- ও নিজের উপর ভারি রাগ করেছিল-- মনে করেছিল, গয়না ফেলে দিয়ে নিজের ভুবনমোহন রূপকে লাঞ্ছনা দেবে-- কিন্তু, সে রূপ অপমানের আঘাতে আরো ফুটে পড়েছে, সে যেন কোথাও আর কিছু ঢাকা নেই। আমাদের রাজাটির নিজের নাকি রূপের সম্পর্ক নেই, তাই তো এই বিচিত্র রূপ সে এত ভালোবাসে,এই রূপই তো তার বক্ষের অলংকার। সেই রূপ আপনার গর্বের আবরণ ঘুচিয়ে দিয়েছে। আজ আমার রাজার ঘরে কী সুরে যে এতক্ষণে বীণা বেজে উঠেছে তাই শোনবার জন্যে প্রাণটা ছট্ফট্ করছে।
সুরঙ্গমা।
ঐ-যে সূর্য উঠল।











