পথ

পথ

প্রথম পথিক।

ওগো মশায়!

প্রহরী।

কেন গো।

দ্বিতীয়।

রাস্তা কোথায়। আমরা বিদেশী, আমাদের রাস্তা বলে দাও।

প্রহরী।

কিসের রাস্তা।

তৃতীয়।

ঐ-যে শুনেছি আজ কোথায় উৎসব হবে। কোন্‌ দিক দিয়ে যাওয়া যাবে।

প্রহরী।

এখানে সব রাস্তাই রাস্তা। যে দিক দিয়ে যাবে ঠিক পৌঁছবে। সামনে চলে যাও।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

প্রথম।

শোনো একবার, কথা শোনো। বলে, সবই এক রাস্তা। তাই যদি হবে তবে এতগুলোর দরকার ছিল কী?

দ্বিতীয়।

তা ভাই, রাগ করিস কেন। যে দেশের যেমন ব্যবস্থা! আমাদের দেশে তো রাস্তা নেই বললেই হয়-- বাঁকাচোরা গলি, সে তো গোলকধাঁদা। আমাদের রাজা বলে, খোলা রাস্তা না থাকাই ভালো; রাস্তা পেলেই প্রজারা বেরিয়ে চলে যাবে। এ দেশে উল্‌টো, যেতেও কেউ ঠেকায় না, আসতেও কেউ মানা করে না-- তবু মানুষও তো ঢের দেখছি--এমন খোলা পেলে আমাদের রাজ্য উজাড় হয়ে যেত!

প্রথম।

ওহে জনার্দন, তোমার ঐ একটা বড়ো দোষ।

জনার্দন।

কী দোষ দেখলে।

প্রথম।

নিজের দেশের তুমি বড়ো নিন্দে কর। খোলা রাস্তাটাই বুঝি ভালো হল? বলো তো ভাই কৌণ্ডিল্য, খোলা রাস্তাটাকে বলে কিনা ভালো।

কৌণ্ডিল্য।

ভাই ভবদত্ত, বরাবরই তো দেখে আসছ জনার্দনের ঐ একরকম তেড়া বুদ্ধি। কোন্‌ দিন বিপদে পড়বেন-- রাজার কানে যদি যায় তা হলে ম'লে ওঁকে শ্মশানে ফেলবার লোক খুঁজে পাবেন না।

ভবদত্ত।

আমাদের তো ভাই এই খোলা রাস্তার দেশে এসে অবধি খেয়ে-শুয়ে সুখ নেই--দিনরাত গা-ঘিনঘিন করছে। কে আসছে কে যাচ্ছে তার কোনো ঠিক-ঠিকানাই নেই--রাম রাম!

কৌণ্ডিল্য।

সেও তো ঐ জনার্দনের পরামর্শ শুনেই এসেছি। আমাদের গুষ্টিতে এমন কখনো হয় নি। আমার বাবাকে তো জান-- কতবড়ো মহাত্মালোক ছিল-- শাস্ত্রমতে ঠিক ঊনপঞ্চাশ হাত মেপে গণ্ডি কেটে তার মধ্যেই সমস্ত জীবনটা কাটিয়ে দিলে-- একদিনের জন্যে তার বাইরে পা ফেলে নি। মৃত্যুর পর কথা উঠল, ঐ ঊনপঞ্চাশ হাতের মধ্যেই তো দাহ করতে হয়। সে এক বিষম মুশকিল। শেষকালে শাস্ত্রী বিধান দিলে যে, ঊনপঞ্চাশে যে দুটো অঙ্ক আছে তার বাইরে যাবার জো নেই, অতএব ঐ চার নয় ঊনপঞ্চাশকে উলটে নিয়ে নয়-চার চুরানব্বই করে দাও। তবেই তো তাকে বাড়ির বাইরে পোড়াতে পারি, নইলে ঘরেই দাহ করতে হত। বাবা, এত আঁটাআঁটি! এ কি যে-সে দেশ পেয়েছ!

ভবদত্ত।

বটেই তো, মরতে গেলেও ভাবতে হবে, এ কি কম কথা!

কৌণ্ডিল্য।

সেই দেশের মাটিতে শরীর, তবু জনার্দন বলে কিনা খোলা রাস্তাই ভালো!

[ সকলের প্রস্থান

[ সকলের প্রস্থান

বালকগণকে লইয়া ঠাকুরদার প্রবেশ

বালকগণকে লইয়া ঠাকুরদার প্রবেশ

ঠাকুরদা।

ওরে, দক্ষিনে হাওয়ার সঙ্গে সমান পাল্লা দিতে হবে, হার মানলে চলবে না-- আজ সব রাস্তাই গানে ভাসিয়ে দিয়ে চলব।

গান

আজি দখিনদুয়ার খোলা--

এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার

বসন্ত এসো।

দিব হৃদয়দোলায় দোলা,

এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার

বসন্ত এসো।

নব শ্যামল শোভন রথে

এসো বকুলবিছানো পথে,

এসো বাজায়ে ব্যাকুল বেণু

মেখে পিয়াল ফুলের রেণু--

এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার

বসন্ত এসো।

এসো ঘনপল্লবপুঞ্জে--

এসো হে, এসো হে, এসো হে।

এসো বনমল্লিকাকুঞ্জে

এসো হে, এসো হে, এসো হে।

মৃদু মধুর মদির হেসে

এসো পাগল হাওয়ার দেশে,

তোমার উতলা উত্তরীয়

তুমি আকাশে উড়ায়ে দিয়ো--

এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার

বসন্ত এসো॥

[ সকলের প্রস্থান

নাগরিকদল

প্রথম।

যা বলিস ভাই, আজকের দিনটাতে আমাদের রাজার দেখা দেওয়া উচিত ছিল। তার রাজ্যে বাস করছি, একদিনও তাকে দেখলুম না, এ কি কম দুঃখের কথা।

দ্বিতীয়।

ওর ভিতরকার কথাটা তোরা কেউ জানিস নে। কাউকে যদি না বলিস তো বলি।

প্রথম।

এক পাড়াতেই তো বসত করছি; কবে কার কথা কাকে বলেছি। ঐ-যে তোমাদের রাহকদাদা কুয়ো খুঁড়তে খুঁড়তে গুপ্তধন পেলে, সে কি আমি সাধ করে ফাঁস করেছি। সব তো জান।

দ্বিতীয়।

জানি বৈকি, সেইজন্যেই তো বলছি-- কথাটা যদি চেপে রাখতে পার তো বলি, নইলে বিপদ ঘটতে পারে।

তৃতীয়।

তুমিও তো আচ্ছা লোক হে বিরূপাক্ষ! বিপদই যদি ঘটতে পারে তবে ঘটাবার জন্যে অত ব্যস্ত হও কেন। কে তোমার কথাটা নিয়ে দিনরাত্রি সামলে বেড়ায়।

বিরূপাক্ষ।

কথাটা উঠে পড়ল নাকি সেইজন্যেই-- তা বেশ, নাই বললেম। আমি বাজে কথা বলবার লোকই নই। রাজা দেখা দেন না সে কথাটা তোমরাই তুললে-- তাই তো আমি বললেম, সাধে দেখা দেব-না।

প্রথম।

ওহে বিরূপাক্ষ, বলেই ফেলো-না।

বিরূপাক্ষ।

তা, তোমাদের কাছে বলতে দোষ নেই, তোমরা হলে বন্ধু-মানুষ। (মৃদুস্বরে) রাজাকে দেখতে বড়ো বিকট, সেইজন্যে পণ করেছে কাউকে দেখা দেবে না।

প্রথম।

তাই তো বটে। আমরা বলি, ভালো রে ভালো, সকল দেশেই রাজাকে দেখে দেশসুদ্ধ লোকের আত্মাপুরুষ বাঁশপাতার মতো হী হী করে কাঁপতে থাকে, আর আমাদেরই রাজাকে দেখা যায় না কেন। কিছু না হোক, একবার যদি চোখ পাকিয়ে বলে "বেটার শির লেও' তা হলেও যে বুঝি রাজা বলে একটা-কিছু আছে। বিরূপাক্ষের কথাটা মনে নিচ্ছে হে।

তৃতীয়।

কিচ্ছু মনে নিচ্ছে না। ওর সিকি পয়সাও বিশ্বাস করি নে।

বিরূপাক্ষ।

কী বললে হে বিশু! তুমি বলতে চাও আমি মিছে কথা বলেছি?

বিশ্ববসু।

তা বলতে চাই নে, কিন্তু কথাটা তাই বলে মানতে পারব না-- এতে রাগই কর আর যাই কর।

বিরূপাক্ষ।

তুমি মানবে কেন। তুমি তোমার বাপখুড়োকেই মান না, এত বুদ্ধি তোমার। এ রাজত্বে রাজা যদি গা ঢাকা দিয়ে না বেড়াত তা হলে কি এখানে তোমার ঠাঁই হত। তুমি তো নাস্তিক বললেই হয়।

বিশ্ববসু।

ওহে আস্তিক, অন্য রাজার দেশ হলে তোমার জিভ কেটে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াত, তুমি বল কিনা আমাদের রাজাকে বিকট দেখতে!

বিরূপাক্ষ।

দেখো বিশু, মুখ সামলে কথা কও।

বিশ্ববসু।

মুখ যে কার সামলানো দরকার সে আর বলে কাজ নেই।

প্রথম।

চুপ চুপ, এ-সব ভালো হচ্ছে না। আমাকে সুদ্ধ বিপদে ফেলবে দেখছি। আমি এ-সব কথার মধ্যে নেই।

[সকলের প্রস্থান

[সকলের প্রস্থান

ঠাকুরদাকে একদল লোকের টানাটানি করিয়া লইয়া প্রবেশ

ঠাকুরদাকে একদল লোকের টানাটানি করিয়া লইয়া প্রবেশ

প্রথম।

ঠাকুরদা, তোমাকে আজ এমন করে সাজালে কে। মালাটি কোন্‌ নিপুণ হাতের গাঁথা।

ঠাকুরদা।

ওরে বোকারা, সব কথাই কি খোলসা করে বলতে হবে নাকি। কিছু ঢাকা থাকবে না?

দ্বিতীয়।

দরকার নেই দাদা, তোমার তো সব ফাঁস হয়েই আছে। আমাদের কবিকেশরী তোমার নামে যে গান বেঁধেছে শোন নি বুঝি? সে যে ঘরে ঘরে রটে গেছে।

ঠাকুরদা।

একটা ঘরই যথেষ্ট, ঘরে ঘরে শুনে বেড়াবার কি সময় আছে।

তৃতীয়।

ওটা তোমার নেহাত ফাঁকা বড়াই। ঠাকরুনদিদি তোমাকে আঁচলে বেঁধে রাখে বটে! পাড়ার যেখানে যাই সেখানেই তুমি, ঘরে থাক কখন।

ঠাকুরদা।

ওরে, তোদের ঠাকরুনদিদির আঁচল লম্বা আছে। পাড়ার যেখানে যাই সে আঁচল ছাড়িয়ে যাবার জো নেই। তা, কবি কী বলছেন শুনি।

তৃতীয়।

তিনি বলছেন--

গান

যেখানে রূপের প্রভা নয়নলোভা

সেখানে তোমার মতন ভোলা কে-- ঠাকুরদাদা!

যেখানে রসিক-সভা পরম শোভা

সেখানে এমন রসের ঝোলা কে-- ঠাকুরদাদা!

ঠাকুরদা।

আরে চুপ চুপ! এমন বসন্তের দিনে তোরা এ কী গান ধরলি রে!

প্রথম।

কেন ধরলুম জান না?--

যেখানে গলাগলি কোলাকুলি

তোমারি বেচাকেনা সেই হাটে,

পড়ে না পদধূলি পথ ভুলি

যেখানে ঝগড়া করে ঝগড়াটে।

যেখানে ভোলাভুলি খোলাখুলি

সেখানে তোমার মতন খোলা কে-- ঠাকুরদাদা!

ঠাকুরদা।

যদি তোরা তোদের সেই কবির কাছে বিধান নিতিস তা হলে শুনতে পেতিস, এই ফাল্গুন মাসের দিনে ঠাকুরদা প্রভৃতি পুরোনো জিনিস মাত্রই একেবারে বর্জনীয়। আমার নামে গান বেঁধে আজ রাগ-রাগিণীর অপব্যয় করিস নে, তোরা সরস্বতীর বীণার তারে মরচে ধরিয়ে দিবি যে।

দ্বিতীয়।

ঠাকুরদা, তুমি তো রাস্তাতেই সভা জমালে, উৎসবে যাবে কখন। চলো আমাদের দক্ষিণ-বনে।

ঠাকুরদা।

ভাই, আমার ঐ দশা, আমি রাস্তা থেকেই চাখতে চাখতে চলি, তার পরে ভোজটা তো আছেই। আদাবন্তে চ মধ্যে চ।

দ্বিতীয়।

দেখো দাদা, আজকের দিনে মনে একটা কথা বড়ো লাগছে।

ঠাকুরদা।

কী বল্‌ দেখি।

দ্বিতীয়।

এবার দেশবিদেশের লোক এসেছে। সবাই বলছে, সবই দেখছি ভালো, কিন্তু রাজা দেখি নে কেন। কাউকে জবাব দিতে পারি নে। আমাদের দেশে ঐটে একটা বড়ো ফাঁকা রয়ে গেছে।

ঠাকুরদা।

ফাঁকা! আমাদের দেশে রাজা এক জায়গায় দেখা দেয় না বলেই তো সমস্ত রাজ্যটা একেবারে রাজায় ঠাসা হয়ে রয়েছে-- তাকে বল ফাঁকা! সে যে আমাদের সবাইকেই রাজা করে দিয়েছে! এই-যে অন্য রাজাগুলো, তারা তো উৎসবটাকে দ'লে ম'লে ছারখার করে দিলে-- তাদের হাতি-ঘোড়া লোক-লশকরের তাড়ায় দক্ষিণ-হাওয়ার দাক্ষিণ্য আর রইল না, বসন্তর যেন দম আটকাবার জো হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজা নিজে জায়গা জোড়ে না, সবাইকে জায়গা ছেড়ে দেয় কবিকেশরীর সেই গানটা তো জানিস।

গান

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে,

নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে।--

আমরা সবাই রাজা।

আমরা যা খুশি তাই করি,

তবু তাঁর খুশিতেই চরি,

আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে,

নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে--

আমরা সবাই রাজা।

রাজা সবারে দেন মান,

সে মান আপনি ফিরে পান,

মোদের খাটো করে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে,

নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে।--

আমরা সবাই রাজা।

আমরা চলব আপন মতে,

শেষে মিলব তারি পথে।

মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে

নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে।--

আমরা সবাই রাজা॥

তৃতীয়।

কিন্তু দাদা, যা বল, তাঁকে দেখতে পায় না বলে লোকে অনায়াসে তাঁর নামে যা খুশি বলে সেইটে অসহ্য হয়।

প্রথম।

এই দেখো-না, আমাকে গাল দিলে শাস্তি আছে, কিন্তু রাজাকে গাল দিলে কেউ তার মুখ বন্ধ করবারই নেই।

ঠাকুরদা।

ওর মনে আছে। প্রজার মধ্যে যে রাজাটুকু আছে তারই গায়ে আঘাত লাগে, তার বাইরে যিনি তাঁর গায়ে কিছুই বাজে না। সূর্যের যে তেজ প্রদীপে আছে তাতে ফুঁটুকু সয় না, কিন্তু হাজার লোকে মিলে সূর্যে ফুঁ দিলে সূর্য অম্লান হয়েই থাকেন।

বিশ্ববসু ও বিরূপাক্ষের প্রবেশ

বিশ্ববসু ও বিরূপাক্ষের প্রবেশ

বিশ্ববসু।

এই-যে ঠাকুরদা, এই দেখো, এই লোকটা রটিয়ে বেড়াচ্ছে-- আমাদের রাজাকে কুৎসিত দেখতে, তাই তিনি দেখা দেন না।

ঠাকুরদা।

এতে রাগ কর কেন বিশু। ওর রাজা কুৎসিত বৈকি, নইলে তার রাজ্যে বিরূপাক্ষের মতো অমন চেহারা থাকে কেন। স্বয়ং ওর বাপ-মা'ও তো ওকে কার্তিক নাম দেন নি। ও আয়নাতে যেমন আপনার মুখটি দেখে, আর রাজার চেহারা তেমনি ধ্যান করে।

বিরূপাক্ষ।

ঠাকুরদা, আমি নাম করব না, কিন্তু এমন লোকের কাছে খবরটা শুনেছি যাকে বিশ্বাস না করে থাকবার জো নেই।

ঠাকুরদা।

নিজের চেয়ে কাকে বেশি বিশ্বাস করবে বলো।

বিরূপাক্ষ।

না, আমি তোমাকে প্রমাণ করে দিতে পারি।

প্রথম।

লোকটার লজ্জা নেই হে। একে তো যা না বলবার তাই বলে, তার পরে আবার সেটা প্রমাণ করে দিতে চায়!

দ্বিতীয়।

ওহে, দাও-না ওকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে একেবারে মাটি-প্রমাণ করে দাও-না।

ঠাকুরদা।

আরে ভাই, রাগ কোরো না। ওর রাজা কুৎসিত এই বলে বেড়িয়েই ও বেচারা আজ উৎসব করতে বেরিয়েছিল। যাও ভাই বিরূপাক্ষ, ঢের লোক পাবে যারা তোমার কথা বিশ্বাস করবে, তাদের নিয়ে দল বেঁধে আজ আমোদ করো গে।

[ সকলের প্রস্থান

বিদেশী দলের পুনঃপ্রবেশ

কৌণ্ডিল্য।

সত্যি বলছি ভাই, রাজা আমাদের এমনি অভ্যেস হয়ে গেছে যে এখানে কোথাও রাজা না দেখে মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু পায়ের তলায় যেন মাটি নেই!

ভবদত্ত।

দেখো ভাই কৌণ্ডিল্য, আসল কথাটা হচ্ছে এদের মূলেই রাজা নেই। সকলে মিলে একটা গুজব রটিয়ে রেখেছে।

কৌণ্ডিল্য।

আমারও তো তাই মনে হয়েছে। আমরা তো জানি দেশের মধ্যে সকলের চেয়ে বেশি করে চোখে পড়ে রাজা-- নিজেকে খুব কষে না দেখিয়ে সে তো ছাড়ে না।

জনার্দন।

কিন্তু এ রাজ্যে আগাগোড়া যেমন নিয়ম দেখছি, রাজা না থাকলে তো এমন হয় না।

ভবদত্ত।

এতকাল রাজার দেশে বাস করে এই বুদ্ধি হল তোমার! নিয়মই যদি থাকবে তা হলে রাজা থাকবার আর দরকার কী।

জনার্দন।

এই দেখো-না, আজ এত লোক মিলে আনন্দ করছে, রাজা না থাকলে এরা এমন করে মিলতেই পারত না।

ভবদত্ত।

ওহে জনার্দন, আসল কথাটাই যে তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ। একটা নিয়ম আছে সেটা তো দেখছি, উৎসব হচ্ছে সেটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সেখানে তো কোনো গোল বাধছে না-- কিন্তু রাজা কোথায়, তাকে দেখলে কোথায় সেইটে বলো।

জনার্দন।

আমার কথাটা হচ্ছে এই যে, তোমরা তো এমন রাজ্য জান যেখানে রাজা কেবল চোখেই দেখা যায়, কিন্তু রাজ্যের মধ্যে তার কোনো পরিচয় নেই; সেখানে কেবল ভূতের কীর্তন-- কিন্তু এখানে দেখো--

কৌণ্ডিল্য।

আবার ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। তুমি ভবদত্তর আসল কথাটার উত্তর দাও-না হে-- হাঁ কি না, রাজাকে দেখেছ কি দেখ নি।

ভবদত্ত।

রেখে দাও ভাই কৌণ্ডিল্য। ওর সঙ্গে মিথ্যে বকাবকি করা। ওর ন্যায়শাস্ত্রটা পর্যন্ত এ-দেশী রকমের হয়ে উঠছে। বিনা-চক্ষে ও যখন দেখতে শুরু করেছে তখন আর ভরসা নেই। বিনা-অন্নে কিছুদিন ওকে আহার করতে দিলে আবার বুদ্ধিটা সাধারণ লোকের মতো পরিষ্কার হয়ে আসতে পারে।

[ সকলের প্রস্থান

বাউলের দল

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,

তাই হেরি তায় সকল খানে।

আছে সে নয়ন-তারায় আলোক-ধারায়, তাই না হারায়--

ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়

তাকাই আমি যে দিক -পানে।

আমি তার মুখের কথা

শুনব বলে গেলাম কোথা,

শোনা হল না, শোনা হল না।

আজ ফিরে এসে নিজের দেশে

এই-যে শুনি,

শুনি তাহার বাণী আপন গানে।

কে তোরা খুঁজিস তারে

কাঙাল-বেশে দ্বারে দ্বারে,

দেখা মেলে না, মেলে না।

ও তোরা আয় রে ধেয়ে, দেখ্‌ রে চেয়ে

আমার বুকে--

ওরে দেখ্‌ রে আমার দুই নয়ানে॥

একদল পদাতিক

প্রথম পদাতিক।

সরে যাও সব, সরে যাও। তফাত যাও।

প্রথম পথিক।

ইস, তাই তো! মস্ত লোক বটে। লম্বা পা ফেলে চলছেন। কেন রে বাপু, সরব কেন। আমরা সব পথের কুকুর নাকি।

দ্বিতীয় পদাতিক।

আমাদের রাজা আসছেন।

দ্বিতীয় পথিক।

রাজা? কোথাকার রাজা।

প্রথম পদাতিক।

আমাদের এই দেশের রাজা।

প্রথম পথিক।

লোকটা পাগল হল নাকি। আমাদের দেশের রাজা পাইক নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে আবার রাস্তায় কবে বেরোয়।

দ্বিতীয় পদাতিক।

মহারাজ আজ আর গোপন করবেন না, তিনি স্বয়ং আজ উৎসব করবেন।

দ্বিতীয় পথিক।

সত্যি নাকি ভাই।

দ্বিতীয় পদাতিক।

ঐ দেখো-না, নিশেন উড়ছে।

দ্বিতীয় পথিক।

তাইতো রে, ওটা নিশেনেই তো বটে।

দ্বিতীয় পদাতিক।

নিশেনে কিংশুক ফুল আঁকা আছে দেখছ না?

দ্বিতীয় পথিক।

ওরে, কিংশুক ফুলই তো বটে। মিথ্যে বলে নি, একেবারে লাল টক্‌টক্‌ করছে।

প্রথম পদাতিক।

তবে! কথাটা যে বড়ো বিশ্বাস হল না!

দ্বিতীয় পথিক।

না দাদা, আমি তো অবিশ্বাস করি নি। ঐ কুম্ভই গোলমাল করেছিল। আমি একটি কথাও বলি নি।

প্রথম পদাতিক।

বেটা বোধ হয় শূন্যকুম্ভ, তাই আওয়াজ বেশি।

দ্বিতীয় পদাতিক।

লোকটা কে হে। তোমাদের কে হয়।

দ্বিতীয় পথিক।

কেউ না, কেউ না। আমাদের গ্রামের যে মোড়ল ও তার খুড়শ্বশুর-- অন্য পাড়ায় বাড়ি।

দ্বিতীয় পদাতিক।

হাঁ হাঁ, খুড়শ্বশুর-গোছের চেহারা বটে, বুদ্ধিটাও নেহাত খুড়শ্বশুরে ধাঁচার।

কুম্ভ।

অনেক দুঃখে বুদ্ধিটা এইরকম হয়েছে। এই-যে সেদিন কোথা থেকে এক রাজা বেরোল, নামের গোড়ায় তিন-শো-পঁয়তাল্লিশটা শ্রী লাগিয়ে ঢাক পিটোতে পিটোতে শহর ঘুরে বেড়ালো-- আমি তার পিছনে কি কম ফিরেছি। কত ভোগ দিলেম, কত সেবা করলেম, ভিটেমাটি বিকিয়ে যাবার জো হল। শেষকালে তার রাজাগিরি রইল কোথায়। লোকে যখন তার কাছে তালুক চায়, মুলুক চায়, সে তখন পাঁজিপুঁথি খুলে শুভদিন কিছুতেই খুঁজে পায় না। কিন্তু আমাদের কাছে খাজনা নেবার বেলায় মঘা অশ্লেষা ত্র৻স্পর্শ কিছুই তো বাধত না!

দ্বিতীয় পদাতিক।

হাঁ হে কুম্ভ, আমাদের রাজাকে তুমি সেইরকম মেকি রাজা বলতে চাও!

প্রথম পদাতিক।

ওহে খুড়শ্বশুর, এবার খুড়শাশুড়ির কাছে থেকে বিদায় নিয়ে এসো গে, আর দেরি নেই।

কুম্ভ।

না বাবা, রাগ কোরো না। আমি কান মলছি, নাকে খত দিচ্ছি-- যতদূর সরতে বল ততদূরই সরে দাঁড়াতে রাজি আছি।

দ্বিতীয় পদাতিক।

আচ্ছা বেশ, এইখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকো। রাজা এলেন বলে। আমরা এগিয়ে গিয়ে রাস্তা ঠিক করে রাখি।

[ পদাতিকের প্রস্থান

[ পদাতিকের প্রস্থান

দ্বিতীয় পথিক।

কুম্ভ, তোমার ঐ মুখের দোষেই তুমি মরবে।

কুম্ভ।

না ভাই মাধব, ও মুখের দোষ নয়, ও কপালের দোষ। যে বারে মিছে রাজা বেরোল একটি কথাও কই নি, অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো নিজের সর্বনাশ করেছি; আর এবার হয়তো-বা সত্যি রাজা বেরিয়েছে, তাই বেফাঁস কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওটা কপাল।

মাধব।

আমি এই বুঝি, রাজা সত্যি হোক মিথ্যে হোক মেনে চলতেই হবে। আমরা কি রাজা চিনি যে বিচার করব! অন্ধকারে ঢেলা মারা-- যত বেশি মারবে একটা-না-একটা লেগে যাবে। আমি ভাই এক-ধার থেকে গড় করে যাই-- সত্যি হলে লাভ; মিথ্যে হলেই-বা লোকসান কী।

কুম্ভ।

ঢেলাগুলো নেহাত ঢেলা হলে ভাবনা ছিল না-- দামী জিনিস-- বাজে খরচ করতে গিয়ে ফতুর হতে হয়।

মাধব।

ঐ-যে আসছেন রাজা। আহা, রাজার মতো রাজা বটে! কী চেহারা! যেন ননির পুতুল। কেমন হে কুম্ভ, এখন কী মনে হচ্ছে।

কুম্ভ।

দেখাচ্ছে ভালো-- কী জানি ভাই, হতে পারে।

মাধব।

ঠিক যেন রাজাটি গড়ে রেখেছে। ভয় হয় পাছে রোদ্‌দুর লাগলে গলে যায়।

রাজবেশধারীর প্রবেশ

রাজবেশধারীর প্রবেশ

মাধব।

জয় মহারাজের! দর্শনের জন্যে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে। দয়া রাখবেন।

কুম্ভ।

বড়ো ধাঁদা ঠেকছে, ঠাকুরদাকে ডেকে আনি।

[ প্রস্থান

আর-এক দল পথিক

প্রথম পথিক।

ওরে, রাজা রে, রাজা! দেখবি আয়।

দ্বিতীয় পথিক।

মনে রেখো রাজা, আমি কুশলীবস্তুর উদয়দত্তর নাতি। আমার নাম বিরাজদত্ত। রাজা বেরিয়েছে শুনেই ছুটেছি, লোকের কারো কথায় কান দিই নি-- আমি সক্কলের আগে তোমাকে মেনেছি।

তৃতীয় পথিক।

শোনো একবার, আমি যে ভোর থেকে এখানে দাঁড়িয়ে-- তখনো কাক ডাকে নি-- এতক্ষণ ছিলে কোথায়। রাজা, আমি বিক্রমস্থলীর ভদ্রসেন, ভক্তকে স্মরণ রেখো।

রাজবেশী।

তোমাদের ভক্তিতে বড়ো প্রীত হলেম।

বিরাজদত্ত।

মহারাজ, আমাদের অভাব বিস্তর। এতদিন দর্শন পাই নি, জানাব কাকে?

রাজবেশী।

তোমাদের সমস্ত অভাব মিটিয়ে দেব।

প্রথম পথিক।

ওরে, পিছিয়ে থাকলে চলবে না-- ভিড়ে মিশে গেলে রাজার চোখে পড়ব না।

দ্বিতীয় পথিক।

দেখ্‌ দেখ্‌, একবার নরোত্তমের কাণ্ডখানা দেখ্‌। আমরা এত লোক আছি-- সবাইকে ঠেলেঠুলে কোথা থেকে এক তালপাতার পাখা নিয়ে রাজাকে বাতাস করতে লেগে গেছে।

মাধব।

তাই তো হে, লোকটার আস্পর্ধা তো কম নয়!

দ্বিতীয় পথিক।

ওকে জোর করে ধরে সরিয়ে দিতে হচ্ছে-- ও কি রাজার পাশে দাঁড়াবার যুগ্যি।

মাধব।

ওহে, রাজা কি আর এটুকু বুঝবে না? এ যে অতিভক্তি।

প্রথম পথিক।

না হে না, রাজারা বোঝে না কিছু। হয়তো ঐ তালপাখার হাওয়া খেয়েই ভুলবে।

[ সকলের প্রস্থান

[ সকলের প্রস্থান

ঠাকুরদাকে লইয়া কুম্ভের প্রবেশ

ঠাকুরদাকে লইয়া কুম্ভের প্রবেশ

কুম্ভ।

এখনই এই রাস্তা দিয়েই যে গেল।

ঠাকুরদা।

রাস্তা দিয়ে গেলেই রাজা হয় নাকি রে।

কুম্ভ।

না দাদা, একেবারে স্পষ্ট চোখে দেখা গেল-- একজন না, দুজন না, রাস্তার দু ধারের লোক তাকে দেখে নিয়েছে।

ঠাকুরদা।

সেইজন্যেই তো সন্দেহ। কবে আমার রাজা রাস্তার লোকের চোখ ধাঁদিয়ে বেড়ায়! এমন উৎপাত তো কোনোদিন করে না।

কুম্ভ।

তা, আজকে যদি মর্জি হয়ে থাকে বলা যায় কি।

ঠাকুরদা।

বলা যায় রে, বলা যায়। আমার রাজার মর্জি বরাবর ঠিক আছে, ঘড়ি-ঘড়ি বদলায় না।

কুম্ভ।

কিন্তু কী বলব দাদা--একেবারে ননির পুতুলটি। ইচ্ছে করে, সর্বাঙ্গ দিয়ে তাকে ছায়া করে রাখি।

ঠাকুরদা।

তোর এমন বুদ্ধি কবে হল। আমার রাজা ননির পুতুল, আর তুই তাকে ছায়া করে রাখবি!

কুম্ভ।

যা বল দাদা, দেখতে বড়ো সুন্দর। আজ তো এত লোক জুটেছে, অমনটি কাউকে দেখলুম না।

ঠাকুরদা।

আমার রাজা যদি-বা দেখা দিত তোদের চোখেই পড়ত না। দশের সঙ্গে তাকে আলাদা বলে চেনাই যায় না-- সে সকলের সঙ্গেই মিশে যায় যে।

কুম্ভ।

ধ্বজা দেখতে পেলুম যে গো।

ঠাকুরদা।

ধ্বজায় কী দেখলি।

কুম্ভ।

কিংশুক ফুল আঁকা-- একেবারে চোখ ঠিকরে যায়।

ঠাকুরদা।

আমার রাজার ধ্বজায় পদ্মফুলের মাঝখানে বজ্র আঁকা।

কুম্ভ।

লোকে বলে, এই উৎসবে রাজা বেরিয়েছে।

ঠাকুরদা।

বেরিয়েছে বৈকি। কিন্তু সঙ্গে পাইক নেই, বাদ্যি নেই, আলো নেই, কিছু না।

কুম্ভ।

কেউ বুঝি ধরতেই পারে না।

ঠাকুরদা।

হয়তো কেউ কেউ পারে।

কুম্ভ।

যে পারে সে বোধ হয় যা চায় তাই পায়।

ঠাকুরদা।

সে যে কিচ্ছু চায় না। ভিক্ষুকের কর্ম নয় রাজাকে চেনা। ছোটো ভিক্ষুক বড়ো ভিক্ষুককেই রাজা বলে মনে করে বসে। আজ যে লোকটা গা-ভরা গয়না পরে রাস্তার দুই ধারের লোকের দুই চক্ষুর কাছে ভিক্ষে চেয়ে বেড়িয়েছে, তোরা লোভীরা তাকেই রাজা বলে ঠাউরে বসে আছিস!-- ঐ-যে আমার পাগলা আসছে। আয় ভাই, আয়-- আর তো বাজে বকতে পারি নে-- একটু মাতামাতি করে নেওয়া যাক।

পাগলের প্রবেশ ও গান

পাগলের প্রবেশ ও গান

তোরা যে যা বলিস ভাই,

আমার সোনার হরিণ চাই।

সেই মনোহরণ চপল-চরণ

সোনার হরিণ চাই।

সে যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়,

যায় না তারে বাঁধা।

তার নাগাল পেলে পালায় ঠেলে,

লাগায় চোখে ধাঁদা।

তবু ছুটব পিছে মিছে মিছে

পাই বা নাহি পাই--

আমি আপন-মনে মাঠে বনে

উধাও হয়ে ধাই।

তোরা পাবার জিনিস হাটে কিনিস,

রাখিস ঘরে ভরে।

যাহা যায় না পাওয়া তারি হাওয়া

লাগল কেন মোরে।

আমার যা ছিল তা দিলেম কোথা

যা নেই তারি ঝোঁকে।

আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি

মরি তাহার শোকে!

ওরে, আছি সুখে হাস্যমুখে,

দুঃখ আমার নাই।

আমি আপন-মনে মাঠে বনে

উধাও হয়ে ধাই॥
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9...20