কুঞ্জদ্বার

ঠাকুরদা ও একদল লোক

কুঞ্জদ্বার

ঠাকুরদা ও একদল লোক

ঠাকুরদা।

কী ভাই, হল তোমাদের?

প্রথম।

খুব হল ঠাকুরদা। এই দেখো-না, একেবারে লালে লাল করে দিয়েছে। কেউ বাকি নেই।

ঠাকুরদা।

বলিস কী। রাজাগুলোকে সুদ্ধ রাঙিয়েছে নাকি।

দ্বিতীয়।

ওরে বাস রে! কাছে ঘেঁষে কে। তারা সব বেড়ার মধ্যে খাড়া হয়ে রইল।

ঠাকুরদা।

হায় হায়, বড়ো ফাঁকিতে পড়েছে। একটুও রঙ ধরাতে পারলি নে? জোর করে ঢুকে পড়তে হয়।

তৃতীয়।

ও দাদা, তাদের রাঙা সে আর-এক রঙের। তাদের চক্ষু রাঙা, তাদের পাইকগুলোর পাগড়ি রাঙা; তার উপরে খোলা তলোয়ারের যেরকম ভঙ্গি দেখলুম, একটু কাছে ঘেঁষলেই একেবারে চরম রাঙা রাঙিয়ে দিত।

ঠাকুরদা।

বেশে করেছিস-- ঘেঁষিস নি। পৃথিবীতে ওদের নির্বাসনদণ্ড-- ওদের তফাতে রেখে চলতেই হবে। এখন বাড়ি চলেছিস বুঝি?

দ্বিতীয়।

হাঁ দাদা, রাত তো আড়াই পহর হয়ে গেল। তুমি যে ভিতরে গেলে না?

ঠাকুরদা।

এখনো ডাক পড়ল না--দ্বারেই আছি।

তৃতীয়।

তোমার শম্ভু-সুধনরা সব গেল কোথায়।

ঠাকুরদা।

তাদের ঘুম পেয়ে গেল-- শুতে গেছে।

প্রথম।

তারা কি তোমার সঙ্গে অমন খাড়া জাগতে পার।

[প্রস্থান

[প্রস্থান

গান

গান

যা ছিল কালো ধলো

তোমার রঙে রঙে রাঙা হল।

যেমন রাঙাবরন তোমার চরণ

তার সনে আর ভেদ না র'ল।

রাঙা হল বসন ভূষণ, রাঙা হল শয়ন স্বপন--

মন হল কেমন দেখ্‌ রে, যেমন

রাঙা কমল টলমল॥

ঠাকুরদা।

বেশ ভাই, বেশ। খুব খেলা জমেছিল?

বাউল।

খুব খুব। সব লালে লাল। কেবল আকাশের চাঁদটাই ফাঁকি দিয়েছে-- সাদাই রয়ে গেল।

ঠাকুরদা।

বাইরে থেকে দেখাচ্ছে যেন বড়ো ভালোমানুষ। ওর সাদা চাদরটা খুলে দেখতিস যদি তা হলে ওর বিদ্যে ধরা পড়ত। চুপিচুপি ও যে আজ কত রঙ ছড়িয়েছে, এখানে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। অথচ ও নিজের কি এমনি সাদাই থেকে যাবে।

গান

আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা

প্রিয় আমার ওগো প্রিয়!

বড়ো উতলা আজ পরান আমার

খেলাতে হার মানবে কি ও।

কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে

রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে।

তুমি সাধ করে নাথ, ধরা দিয়ে

আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো--

এই হৃৎকমলের রাঙা রেণু

রাঙাবে ওই উত্তরীয়॥

[প্রস্থান

[প্রস্থান

স্ত্রীলোকদের প্রবেশ

স্ত্রীলোকদের প্রবেশ

প্রথমা।

ওমা, ওমা! যেখানে দেখে গিয়েছিলুম সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে গো!

দ্বিতীয়া।

আমাদের বসন্তপূর্ণিমার চাঁদ, এত রাত হল তবু একটুও পশ্চিমের দিকে হেলল না।

প্রথমা।

আমাদের অচঞ্চল চাঁদটি কার জন্যে পথ চেয়ে আছে ভাই।

ঠাকুরদা।

যে তাকে পথে বের করবে তারই জন্যে।

তৃতীয়া।

ঘর ছেড়ে এবার পথের মানুষ খুঁজবে বুঝি?

ঠাকুরদা।

হাঁ ভাই, সর্বনাশের জন্যে মন কেমন করছে।

গান

আমার সকল নিয়ে বসে আছি

সর্বনাশের আশায়।

আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি।

পথে যে জন ভাসায়।

দ্বিতীয়া।

আমাদের তো পথে ভাসাবার শক্তি নেই, পথ ছেড়ে দিয়ে যাওয়াই ভালো। ধরা যে দেবে না তার কাছে ধরা দিয়ে লাভ কী।

ঠাকুরদা।

তার কাছে ধরা দিলে ধরা দেওয়াও যা, ছাড়া পাওয়াও তা।

যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে,

ভালোবাসে আড়াল থেকে,

আমার মন মজেছে সেই গভীরের

গোপন ভালোবাসায়॥

[স্ত্রীলোকদের প্রস্থান

[স্ত্রীলোকদের প্রস্থান

নাচের দলের প্রবেশ

নাচের দলের প্রবেশ

ঠাকুরদা।

ও ভাই, রাত তো অর্ধেকের বেশি পার হয়ে এল, কিন্তু মনের মাতন এখনো যে থামতে চাইছে না। তোরা তো বাড়ি চলেছিস, তোদের শেষ নাচটা নাচিয়ে দিয়ে যা।

গান

আমার ঘুর লেগেছে-- তাধিন তাধিন।

তোমার পিছন পিছন নেচে নেচে

ঘুর লেগেছে তাধিন তাধিন।

তোমার তালে আমার চরণ চলে,

শুনতে না পাই কে কী বলে--

তাধিন তাধিন।

তোমার গানে আমার প্রাণে যে কোন্‌

পাগল ছিল সেই জেগেছে--

তাধিন তাধিন।

আমার লাজের বাঁধন সাজের বাঁধন

খসে গেল ভজন সাধন--

তাধিন তাধিন।

বিষম নাচের বেগে দোলা লেগে

ভাবনা যত সব ভেগেছে--

তাধিন তাধিন।

[নাচের দলের প্রস্থান

[নাচের দলের প্রস্থান

সুরঙ্গমার প্রবেশ

সুরঙ্গমার প্রবেশ

সুরঙ্গমা।

এতক্ষণ কী করছিলে ঠাকুরদা।

ঠাকুরদা।

দ্বারের কাজে ছিলুম।

সুরঙ্গমা।

সে কাজ তো শেষ হল। একটি মানুষও নেই-- সবাই চলে গেছে।

ঠাকুরদা।

এবার তবে ভিতরে চলি।

সুরঙ্গমা।

কোন্‌খানে বাঁশি বাজছে, এবার বাতাসে কান দিলে বোঝা যাবে।

ঠাকুরদা।

সবাই যখন নিজের তালপাতার ভেঁপু বাজাচ্ছিল তখন বিষম গোল।

সুরঙ্গমা।

উৎসবে ভেঁপুর ব্যবস্থা তিনিই করে রেখেছেন।

ঠাকুরদা।

তাঁর বাঁশি কারো বাজনা ছাপিয়ে ওঠে না, তা না হলে লজ্জায় আর-সকলের তান বন্ধ হয়ে যেত।

সুরঙ্গমা।

দেখো ঠাকুরদা, আজ এই উৎসবের ভিতরে ভিতরে কেবলই আমার মনে হচ্ছে, রাজা আমাকে এবার দুঃখ দেবেন।

ঠাকুরদা।

দুঃখ দেবেন!

সুরঙ্গমা।

হাঁ ঠাকুরদা। এবার আমাকে দূরে পাঠিয়ে দেবেন, অনেক দিন কাছে আছি সে তাঁর সইছে না।

ঠাকুরদা।

এবার তবে কাঁটাবনের পার থেকে তোমাকে দিয়ে পারিজাত তুলিয়ে আনাবেন। সেই দুর্গমের খবরটা আমরা যেন পাই ভাই।

সুরঙ্গমা।

তোমার নাকি কোনো খবর পেতে বাকি আছে! রাজার কাজে কোন্‌ পথটাতেই বা তুমি না চলেছ। হঠাৎ নতুন হুকুম এলে আমাদেরই পথ খুঁজে বেড়াতে হয়।

গান

পুষ্প ফুটে কোন্‌ কুঞ্জবনে

কোন্‌ নিভৃতে রে, কোন্‌ গহনে।

মাতিল আকুল দক্ষিণাবায়ু

সৌরভচঞ্চল সঞ্চরণে

কোন্‌ নিভৃতে রে, কোন্‌ গহনে।

কাটিল ক্লান্ত বসন্তনিশা

বাহির-অঙ্গন-সঙ্গী-সনে।

উৎসবরাজ কোথায় বিরাজে--

কে লয়ে যাবে সে ভবনে,

কোন্‌ নিভৃতে রে কোন্‌ গহনে॥

[সুরঙ্গমার প্রস্থান

[সুরঙ্গমার প্রস্থান

রাজবেশী ও কাঞ্চীরাজের প্রবেশ

রাজবেশী ও কাঞ্চীরাজের প্রবেশ

কাঞ্চী।

তোমাকে যেমন পরামর্শ দিয়েছি ঠিক সেইরকম কোরো। ভুল না হয়।

রাজবেশী।

ভুল হবে না।

কাঞ্চী।

করভোদ্যানের মধ্যেই রানীর প্রাসাদ।

রাজবেশী।

হাঁ মহারাজ, সে আমি দেখে নিয়েছি।

কাঞ্চী।

সেই উদ্যানে আগুন লাগিয়ে দেবে-- তার পরে অগ্নিদাহের গোলমালের মধ্যে কার্যসিদ্ধি করতে হবে।

রাজবেশী।

কিছু অন্যথা হবে না।

কাঞ্চী।

দেখো হে ভণ্ডরাজ, আমার কেবলই মনে হচ্ছে, আমরা মিথ্যে ভয়ে ভয়ে চলছি, এ দেশে রাজা নেই।

রাজবেশী।

সেই অরাজকতা দূর করবার জন্যেই তো আমার চেষ্টা। সাধারণ লোকের জন্যে, সত্য হোক মিথ্যে হোক একটা রাজা চাইই-- নইলে অনিষ্ট ঘটে।

কাঞ্চী।

হে সাধু, লোকহিতের জন্যে তোমার এই আশ্চর্য ত্যাগস্বীকার আমাদের সকলেরই পক্ষে একটা দৃষ্টান্ত। ভাবছি যে, এই হিতকার্যটা নিজেই করব। (সহসা ঠাকুরদাকে দেখিয়া) কে হে, কে তুমি। কোথায় লুকিয়ে ছিলে।

ঠাকুরদা।

লুকিয়ে থাকি নি। অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলে আপনাদের চোখে পড়ি নি।

রাজবেশী।

ইনি এ দেশের রাজাকে নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দেন,নির্বোধেরা বিশ্বাস করে।

ঠাকুরদা।

বুদ্ধিমানদের কিছুতেই সন্দেহ ঘোচে না, তাই নির্বোধ নিয়েই আমাদের কারবার।

কাঞ্চী।

তুমি আমাদের সব কথা শুনেছ?

ঠাকুরদা।

আপনারা আগুন লাগাবার পরামর্শ করছিলেন।

কাঞ্চী।

তুমি আমাদের বন্দী, চলো শিবিরে।

ঠাকুরদা।

আজ তবে বুঝি এমনি করেই তলব পড়ল?

কাঞ্চী।

বিড়্‌ বিড়্‌ করে বকছ কী?

ঠাকুরদা।

আমি বলছি, দেশের টান কাটিয়ে কিছুতেই নড়তে পারছিলেম না, তাই বুঝি ভিতর-মহলে টেনে নিয়ে যাবার জন্যে মনিবের পেয়াদা এল।

কাঞ্চী।

লোকটা পাগল নাকি।

রাজবেশী।

ওর কথা ভারি এলোমেলো-- বোঝাই যায় না।

কাঞ্চী।

কথা যত কম বোঝা যায় অবুঝরা ততই ভক্তি করে। কিন্তু আমাদের কাছে সে ফন্দি খাটবে না। আমরা স্পষ্ট কথার কারবারি।

ঠাকুরদা।

যে আজ্ঞে মহারাজ, চুপ করলুম।
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9...20