প্রাসাদশিখর

সুদর্শনা ও সখী রোহিণী

প্রাসাদশিখর

সুদর্শনা ও সখী রোহিণী

সুদর্শনা।

ওলো রোহিণী, তুই আমার রাজাকে কি কখনো দেখিস নি।

রোহিণী।

শুনেছি প্রজারা সবাই দেখেছে, কিন্তু চিনেছে খুব অল্প লোকে। সেইজন্যে যখনই কাউকে দেখে মনটা চমকে ওঠে তখনই মনে করি, এই বুঝি হবে রাজা। আবার দুদিন পরে ভুল ভাঙে।

সুদর্শনা।

ভুল তোরা করতে পারিস, কিন্তু আমার ভুল হতে পারে না। আমি হলুম রাণী। ঐ তো আমার রাজাই বটে।

রোহিণী।

তোমাকে তিনি কত মান দিয়েছেন; তিনি কি তোমাকে চেনাতে দেরি করতে পারেন।

সুদর্শনা।

ঐ মূর্তি দেখলেই চিত্ত যে আপনি খাঁচার পাখির মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর কথা ভালো করে জিজ্ঞাসা করে এসেছিস তো?

রোহিণী।

এসেছি বৈকি। যাকে জিজ্ঞাসা করি সেই তো বলে-- রাজা।

সুদর্শনা।

কোথাকার রাজা

রোহিণী।

আমাদেরই রাজা।

সুদর্শনা।

ঐ যার মাথায় ফুলের ছাতা ধরে আছে তার কথাই তো বলছিস?

রোহিণী।

হাঁ, ঐ যাঁর পতাকায় কিংশুক আঁকা।

সুদর্শনা।

আমি তো দেখবামাত্রই চিনেছি, বরঞ্চ তোর মনে সন্দেহ এসেছিল।

রোহিণী।

আমাদের যে সাহস অল্প, তাই ভয় হয়, কী জানি যদি ভুল করি তবে অপরাধ হবে।

সুদর্শনা।

আহা, যদি সুরঙ্গমা থাকত তা হলে কোনো সংশয় থাকত না।

রোহিণী।

সুরঙ্গমাই আমাদের সকলের চেয়ে সেয়ানা হল বুঝি!

সুদর্শনা।

তা যা বলিস। সে তাঁকে ঠিক চেনে।

রোহিণী।

এ কথা আমি কক্‌খনো মানব না। ও তার ভান। বললেই হল চিনি, কেউ তো পরীক্ষা করে নিতে পারবে না। আমরা যদি ওর মতো নির্লজ্জ হতুম তা হলে অমন কথা আমাদেরও মুখে আটকাত না।

সুদর্শনা।

না না, সে তো বলে না কিছু।

রোহিণী।

ভাব দেখায়। সে যে বলার চেয়ে আরো বেশি। কত ছলই যে জানে! ঐজন্যেই তো আমাদের কেউ তাকে দেখতে পারে না।

সুদর্শনা।

যাই হোক, সে থাকলে একবার তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখতুম।

রোহিণী।

সে তো কখনো কোথাও বেরোয় না-- আজ দেখি সে সাজসজ্জা করে উৎসব করতে বেরিয়েছে। তার রঙ্গ দেখে হেসে বাঁচি নে।

সুদর্শনা।

আজ যে প্রভুর হুকুম, তাই সে সেজেছে।

রোহিণী।

তা বেশ মহারানী, আমাদের কথায় কাজ কী। যদি ইচ্ছা করেন তাকেই ডেকে আনি, তার মুখ থেকেই সন্দেহভঞ্জন হোক। তার ভাগ্য ভালো, রানীর কাছে রাজার পরিচয় সে'ই করিয়ে দেবে।

সুদর্শনা।

না না, পরিচয় কাউকে করাতে হবে না-- তবু কথাটা সকলেরই মুখে শুনতে ইচ্ছে করে।

রোহিণী।

সকলেই তো বলছে-- ঐ দেখো-না, তাঁর জয়ধ্বনি এখান থেকে শোনা যাচ্ছে।

সুদর্শনা।

তবে এক কাজ কর্‌। পদ্মপাতায় করে এই ফুলগুলি তাঁর হাতে দিয়ে আয় গে।

রোহিণী।

যদি জিজ্ঞাসা করেন, কে দিলে।

সুদর্শনা।

তার কোনো উত্তর দিতে হবে না-- তিনি ঠিক বুঝতে পারবেন। তাঁকে মনে ছিল, আমি চিনতেই পারব না-- ধরা পড়েছেন সেটা না জানিয়ে ছাড়ছি নে। (ফুল লইয়া রোহিণীর প্রস্থান) আমার মন আজ এমনি চঞ্চল হয়েছে-- এমন তো কোনোদিন হয় না। এই পূর্ণিমার আলো মদের ফেনার মতো চারি দিকে উপচিয়ে পড়ছে, আমাকে যেন মাতাল করে তুলেছে। ওগো বসন্ত, যে-সব ভীরু, লাজুক ফুল পাতার আড়ালে গভীর রাত্রে ফোটে, যেমন করে তাদের গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে চলেছ তেমনি তুমি আমার মনকে হঠাৎ কোথায় উদাস করে দিলে, তাকে মাটিতে পা ফেলতে দিলে না!-- ওরে প্রতিহারী।

প্রতিহারী।

(প্রবেশ করিয়া) কী মহারানী।

সুদর্শনা।

ঐ-যে আম্রবনের বীথিকার ভিতর দিয়ে উৎসব-বালকেরা আজ গান গেয়ে যাচ্ছে-- ডাক্‌ ডাক্‌, ওদের ডেকে নিয়ে আয়-- একটু গান শুনি। (প্রতিহারীর প্রস্থান) ভগবান চন্দ্রমা, আজ আমার এই চঞ্চলতার উপরে তুমি যেন কেবলই কটাক্ষপাত করছ! তোমার স্মিত কৌতুকে সমস্ত আকাশ যেন ভরে গেছে-- কোথাও আমার আর লুকোবার জায়গা নেই-- আমি কেমন আপনার দিকে চেয়ে আপনি লজ্জা পাচ্ছি! ভয় লজ্জা সুখ দুঃখ সব মিলে আমরা বুকের মধ্যে আজ নৃত্য করছে-- শরীরের রক্ত নাচছে, চারি দিকের জগৎ নাচছে, সমস্ত ঝাপসা ঠেকছে।

বালকগণের প্রবেশ

এসো এসো, তোমরা সব মূর্তিমান কিশোর বসন্ত, ধরো, তোমাদের গান ধরো। আমার সমস্ত শরীর মন গান গাইছে, অথচ আমার কণ্ঠে সুর আসছে না। তোমরা আমার হয়ে গান গেয়ে যাও।

বালকগণের গান

বালকগণের গান

বিরহ মধুর হল আজি

মধুরাতে।

গভীর রাগিণী উঠে বাজি

বেদনাতে।

ভরি দিয়া পূর্ণিমানিশা

অধীর অদর্শনতৃষা

কী করুণ মরীচিকা আনে

আঁখিপাতে!

সুদূরের সুগন্ধধারা

বায়ুভরে

পরানে আমার পথহারা

ঘুরে মরে।

কার বাণী কোন্‌ সুরে তালে

মর্মরে বল্লবজালে,

বাজে মম মঞ্জীররাজি

সাথে সাথে॥

সুদর্শনা।

হয়েছে হয়েছে, আর না। তোমাদের এই গান শুনে চোখে জল ভরে আসছে। আমার মনে হচ্ছে, যা পাবার জিনিস তাকে হাতে পাবার জো নেই; তাকে হাতে পাবার দরকার নেই। এমনি করে খোঁজার মধ্যেই সমস্ত পাওয়া যেন সুধাময় হয়ে আছে। কোন্‌ মাধুর্যের সন্ন্যাসী তোমাদের এই গান শিখিয়ে দিয়েছে গো--ইচ্ছে করছে, চোখে-দেখা কানে-শোনা ঘুচিয়ে দিই, হৃদয়ের ভিতরটাতে যে গহন পথের কুঞ্জবন আছে সেইখানকার ছায়ার মধ্যে উদাস হয়ে চলে যাই। ওগো কুমার তাপসগণ, তোমাদের আমি কী দেব বলো! আমার গলায় এ কেবল রত্নের মালা, এ কঠিন হার তোমাদের কণ্ঠে পীড়া দেবে-- তোমরা যে ফুলের মালা পরেছ ওর মতো কিছুই আমার কাছে নেই।

[ প্রণাম করিয়া বালকগণের প্রস্থান

[ প্রণাম করিয়া বালকগণের প্রস্থান

রোহিণীর প্রবেশ

রোহিণীর প্রবেশ

সুদর্শনা।

ভালো করি নি, ভালো করি নি রোহিণী। তোর কাছে সমস্ত বিবরণ শুনতে আমার লজ্জা করছে। এইমাত্র হঠাৎ বুঝতে পেরেছি, যা সকলের চেয়ে বড়ো পাওয়া তা ছুঁয়ে পাওয়া নয়, তেমনি যা সকলের চেয়ে বড়ো দেওয়া তা হাতে করে দেওয়া নয়। তবু বল্‌, কী হল বল্‌।

রোহিণী।

আমি তো রাজার হাতে ফুল দিলুম, কিন্তু তিনি যে কিছু বুঝলেন এমন তো মনে হল না।

সুদর্শনা।

বলিস কী! তিনি বুঝতে পারলেন না?

রোহিণী।

না, তিনি অবাক হয়ে চেয়ে পুতুলটির মতো বসে রইলেন। কিছু বুঝলেন না এইটে পাছে ধরা পড়ে সেইজন্যে একটি কথা কইলেন না।

সুদর্শনা।

ছি ছি ছি, আমার যেমন প্রগল্‌ভতা তেমনি শাস্তি হয়েছে। তুই আমার ফুল ফিরিয়ে আনলি নে কেন।

রোহিণী।

ফিরিয়ে আনব কী করে। পাশে ছিলেন কাঞ্চীর রাজা। তিনি খুব চতুর--চকিতে সমস্ত বুঝতে পারলেন; মুচকে হেসে বললেন, "মহারাজ, মহিষী সুদর্শনা আজ বসন্তসখার পূজার পুষ্পে মহারাজের অভ্যর্থনা করছেন।' শুনে হঠাৎ তিনি সচেতন হয়ে উঠে বললেন, "আমার রাজসম্মান পরিপূর্ণ হল।' আমি লজ্জিত হয়ে ফিরে আসছিলুম, এমন সময়ে কাঞ্চীর রাজা মহারাজের গলা থেকে স্বহস্তে এই মুক্তার মালাটি খুলে নিয়ে আমাকে বললেন, "সখী, তুমি যে সৌভাগ্য বহন করে এনেছ তার কাছে পরাভব স্বীকার করে মহারাজের কণ্ঠের মালা তোমার হাতে আত্মসমর্পণ করছে।'

সুদর্শনা।

কাঞ্চীর রাজাকে বুঝিয়ে দিতে হল! আজকের পূর্ণিমার উৎসব আমার অপমান একেবারে উদ্‌ঘাটিত করে দিলে। তা হোক, যা, তুই যা। আমি একটু একলা থাকতে চাই। (রোহিণীর প্রস্থান) আজ এমন করে আমার দর্প চূর্ণ হয়েছে, তবু সেই মোহন রূপের কাছ থেকে মন ফেরাতে পারছি নে। অভিমান আর রইল না-- পরাভব, সর্বত্রই পরাভব-- বিমুখ হয়ে থাকব সে শক্তিটুকুও নেই। কেবল ইচ্ছে করছে, ঐ মালাটা রোহিণীর কাছ থেকে চেয়ে নিই। কিন্তু ও কী মনে করবে। রোহিণী!

রোহিণী।

(প্রবেশ করিয়া) কী মহারানী।

সুদর্শনা।

আজকের ব্যাপারে তুই কি পুরস্কার পাবার যোগ্য।

রোহিণী।

তোমার কাছে না হোক, যিনি দিয়াছেন তাঁর কাছ থেকে পেতে পারি।

সুদর্শনা।

না না, ওকে দেওয়া বলে না, ও জোর করে নেওয়া।

রোহিণী।

তবু, রাজকণ্ঠের অনাদরের মালাকেও অনাদর করি এমন স্পর্ধা আমার নয়।

সুদর্শনা।

এ অবজ্ঞার মালা তোর গলায় দেখতে আমার ভালো লাগছে না। দে, ওটা খুলে দে। ওরা বদলে আমার হাতের কঙ্কণটা তোকে দিলুম-- এই নিয়ে তুই চলে যা। (রোহিণীর প্রস্থান) হার হল, আমার হার হল। এ মালা ছুড়ে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল-- পারলুম না। এ যে কাঁটার মালার মতো আমার আঙুলে বিঁধছে, তবু ত্যাগ করতে পারলুম না। উৎসবদেবতার হাত থেকে এই আমি পেলুম-- এই অগৌরবের মালা।
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9...20