পথে

সন্ন্যাসী

পথে

সন্ন্যাসী

এসেছি অনেক দূরে -- আর ভয় নাই।

পায়েতে জড়াল লতা, ছিন্ন হয়ে গেল।

সেই মুখ বার বার জাগিতেছে মনে।

সে যেন করুণ মুখে মনের দুয়ারে

বসে বসে কাঁদিতেছে ডাকিতেছে সদা।

যতই রাখিতে চাই দুয়ার রুধিয়া --

কিছুতেই যাবে না সে, ফিরে ফিরে আসে,

একটু মনের মাঝে স্থান পেতে চায়।

নির্ভয়ে গা ঢেলে দিয়ে সংসারের স্রোতে

এরা সবে কী আরামে চলেছে ভাসিয়া।

যে যাহার কাজ করে, গৃহে ফিরে যায়,

ছোটো ছোটো সুখে দুঃখে দিন যায় কেটে।

আমি কেন দিবানিশি প্রাণপণ করে

যুঝিতেছি সংসারের স্রোত-প্রতিকূলে।

পেরেছি কি এক তিল অগ্রসর হতে।

বিপরীতে মুখ শুধু ফিরাইয়া আছি,

উজানে যেতেছি বলে হইতেছে ভ্রম,

পশ্চাতে স্রোতের টানে চলেছি ভাসিয়া,

সবাই চলেছে যেথা ছুটেছি সেথাই।

দরিদ্র বালিকার প্রবেশ

দরিদ্র বালিকার প্রবেশ

বালিকা।

ওগো, দয়া করো মোরে আমি অনাথিনী।

সন্ন্যাসী।

(সহসা চমকিয়া উঠিয়া)

কে রে তুই? কে রে বাছা? কোথা হতে এলি?

অনাথিনী? তুইও কি তারি মতো তবে?

তোরেও কি ফেলে কেউ গিয়েছে পলায়ে?

তারেই কি চারি দিকে খুঁজিয়া বেড়াস?

বৎসে, কাছে আয় তুই -- দে রে পরিচয়।

বালিকা।

ভিখারি বালিকা আমি, সন্ন্যাসী ঠাকুর,

অন্ধ বৃদ্ধ মাতা মোর রোগশয্যাশায়ী।

আসিয়াছি একমুঠা ভিক্ষান্নের তরে।

সন্ন্যাসী।

আহা বৎসে, নিয়ে চল্‌ কুটিরেতে তোর।

রুগ্‌ণ তোর জননীরে দেখে আসি আমি।

[প্রস্থান

[প্রস্থান

কতকগুলি সন্তান লইয়া এক জন স্ত্রীলোকের প্রবেশ

কতকগুলি সন্তান লইয়া এক জন স্ত্রীলোকের প্রবেশ

স্ত্রী।

দেখ দেখি মিশ্রদের বাড়ির ছেলেগুলি কেমন রিষ্টপুষ্ট! দেখলে দু-দণ্ড চেয়ে থাকতে ইচ্ছা করে - আর এদের ছিরি দেখো না, যেন বৃষকাষ্ঠ দাঁড়িয়ে আছেন, যেন সাতকুলে কেউ নেই, যেন সাত জন্মে খেতে পান না।

সন্তানগণ।

তা আমরা কী করব মা। আমাদের দোষ কী?

মা।

বললেম, বলি, রোজ সকালে ভালো করে হলুদ মেখে তেল মেখে স্তান কর্‌ -- ধাত পোষ্টাই হবে, ছিরি ফিরবে, তা তো কেউ শুনবে না! আহা ওদের দিকে চাইলে চোখ জুড়িয়ে যায়, রং যেন দুধে-আলতায় --

সন্তানগণ।

আমাদের রং কালো তা আমরা কী করব?

মা।

তোদের রং কালো কে বললে? তোদের রং মন্দ কী? তবে কেন ওদের মতো দেখায় না?

সন্ন্যাসীর প্রবেশ

সন্ন্যাসী।

কোথায় চলেছ বাছা।

স্ত্রী।

প্রণাম ঠাকুর!

ঘরেতে যেতেছি মোরা।

সন্ন্যাসী।

সেথায় কে আছে?

স্ত্রী।

শাশুড়ী আছেন মোর, আছেন সোয়ামী,

শত্রু-মুখে ছাই দিয়ে দুটি ছেলে আছে।

সন্ন্যাসী।

কী কাজে কাটাও দিন বলো মোরে বাছা!

স্ত্রী।

ঘরকন্না-কাজ আছে, ছেলেপিলে আছে,

গোয়ালে তিনটি গোরু তার করি সেবা,

বিকেলে চরকা কাটি মেয়েটিরে নিয়ে।

সন্ন্যাসী।

সুখেতে কি কাটে দিন? দুঃখ কিছু নেই?

স্ত্রী।

দয়ার শরীর রাজা প্রজার মা-বাপ,

কোনো দুঃখ নেই প্রভু রামরাজ্যে থাকি।

সন্ন্যাসী।

এটি কি তোমারি মেয়ে বাছা!

স্ত্রী।

হাঁ ঠাকুর।

(কন্যার প্রতি) যা না রে, প্রভুরে গিয়ে কর্‌ দণ্ডবৎ।

সন্ন্যাসী।

আয় বৎসে কাছে আয় কোলে করি তোরে।

আসিবি নে! তুই মোরে চিনেছিস বুঝি --

নিষ্ঠুর কঠিন আমি পাষাণ হৃদয়,

আমারে বিশ্বাস করে আসিস নে কাছে!

কন্যা।

(মাকে টানিয়া) মা গো ঘরে চল।

স্ত্রী।

তবে প্রণাম ঠাকুর।

সন্ন্যাসী।

যাও বাছা, সুখে থাকো আশীর্বাদ করি।

[সন্ন্যাসী ব্যতীত সকলের প্রস্থান

বসে বসে কী দেখি এ, এই কি রে সুখ।

লঘু সুখ লঘু আশা বাহিয়া বাহিয়া

সংসার-সাগরে এরা ভাসিয়া বেড়ায়,

তরঙ্গের নৃত্য সনে নৃত্য করিতেছে।

দু-দিনেতে জীর্ণ হবে এ ক্ষুদ্র তরণী,

আশ্রয়ের সাথে কোথা মজিবে পাথারে।

আমি তো পেয়েছি কূল অটল পর্বতে,

নিত্য যাহা তারি মাঝে করিতেছি বাস।

আবার কেন রে হোথা সন্তরণ-সাধ!

ওই অশ্রু-সাগরের তরঙ্গ-হিল্লোলে

আবার কি দিবানিশি উঠিবি পড়িবি!

(চক্ষু মুদিয়া) হৃদয় রে শান্ত হও, যাক সব দূরে।

যাক দূরে, যাক চলে মায়া-মরীচিকা।

এস এস অন্ধকার, প্রলয়-সমুদ্রে

তপ্ত দীপ্ত দগ্ধ প্রাণ দাও ডুবাইয়া।

অকুল স্তব্ধতা এস চারি দিকে ঘিরে,

কোলাহলে কর্ণ মোর হয়েছে বধির।

গেল, সব ডুবে গেল, হইল বিলীন,

হৃদয়ের অগ্নিজ্বালা সব নিবে গেল।

বালিকার প্রবেশ

বালিকার প্রবেশ

বালিকা।

পিতা, পিতা, কোথা তুমি পিতা।

সন্ন্যাসী।

(চমকিয়া) কে রে তুই!

চিনি নে, চিনি নে তোরে, কোথা হতে এলি!

বালিকা।

আমি, পিতা, চাও পিতা, দেখো পিতা, আমি!

সন্ন্যাসী।

চিনি নে, চিনি নে তোরে, ফিরে যা, ফিরে যা।

আমি কারো কেহ নই আমি যে স্বাধীন।

বালিকা।

(পায়ে পড়িয়া) আমাকে যেয়ো না ফেলে, আমি নিরাশ্রয়।

শুধায়ে শুধায়ে সবে তোমারে খুঁজিয়া

বহু দূর হতে পিতা, এসেছি যে আমি।

সন্ন্যাসী।

(সহসা ফিরিয়া আসিয়া, বুকে টানিয়া)

আয় বাছা, বুকে আয়, ঢাল্‌ অশ্রুধারা,

ভেঙে যাক এ পাষাণ তোর অশ্রুস্রোতে,

আর তোরে ফেলে আমি যাব না বালিকা,

তোরে নিয়ে যাব আমি নূতন জগতে।

পদাঘাতে ভেঙেছিনু জগৎ আমার --

ছোটো এ বালিকা এর ছোটো দুটি হাতে

আবার ভাঙা জগৎ গড়িয়া তুলিল।

আহা, তোর মুখখানি শুকায়ে গিয়েছে,

চরণ দাঁড়াতে যেন পারিছে না আর।

অনিদ্রায়, অনাহারে, মধ্যাহ্ন-তপনে

তিন দিবসের পথ কেমনে এলি রে!

আয় রে বালিকা তোরে বুকে করে নিয়ে

যেথা ছিনু ফিরে যাই সেই গুহামাঝে।
1...8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17