গুহার বাহিরে

গুহার বাহিরে

সন্ন্যাসী।

আহা এ কী চারিদিকে প্রভাত-বিকাশ।

এ জগৎ মিথ্যা নয়, বুঝি সত্য হবে,

মিথ্যা হয়ে প্রকাশিছে আমাদের চোখে।

অসীম হতেছে ব্যক্ত সীমারূপ ধরি।

যাহা কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, অনন্ত সকলি,

বালুকার কণা সেও অসীম অপার,

তারি মধ্যে বাঁধা আছে অনন্ত আকাশ --

কে আছে কে পারে তারে আয়ত্ত করিতে?

বড়ো ছোটো কিছু নাই সকলি মহৎ।

আঁখি মুদে জগতেরে বাহিরে ফেলিয়া

অসীমের অন্বেষণে কোথা গিয়েছিনু!

সীমা তো কোথাও নাই -- সীমা সে তো ভ্রম।

ভালো করে পড়িব এ জগতের লেখা,

শুধু এ অক্ষর দেখে করিব না ঘৃণা।

লোক হতে লোকান্তরে ভ্রমিতে ভ্রমিতে,

একে একে জগতের পৃষ্ঠা উলটিয়া,

ক্রমে যুগে যুগে হবে জ্ঞানের বিস্তার।

বিশ্বের যথার্থ রূপ কে পায় দেখিতে।

আঁখি মেলি চারি দিকে করিবে ভ্রমণ

ভালোবেসে চাহিব এ জগতের পানে

তবে তো দেখিতে পাব স্বরূপ ইহার।

দুই জন পথিকের প্রবেশ

দুই জন পথিকের প্রবেশ

প্রথম।

আর কতদূরে যাবি, ফিরে যা রে ভাই।

আয় ভাই এইখানে কোলাকুলি করি।

দ্বিতীয়।

কে জানে আবার কবে দেখা হবে ফিরে।

প্রথম।

আবার আসিব ফিরে যত শীঘ্র পারি।

দ্বিতীয়।

যাবে যদি, এক বার দাঁড়াও হেথায়।

এক বার ফিরে চাও নগরের পানে।

ওই দেখো দূরে ওই গৃহটি তোমার,

চারি দিকে রহিয়াছে লতিকার বেড়া,

ওই সে অশোক গাছ বামে উঠিয়াছে,

ওই তরুতলে বসে আমরা দু-জনে

কত রাত্রি জোছনাতে কথা কহিয়াছি।

প্রথম।

দুদিনের এ বিরহ ত্বরায় ফুরাবে

আনন্দের মাঝে পুন হইবে মিলন।

দ্বিতীয়।

মনে যেন রেখো সখা সুদূর প্রবাসে,

পুরাতন এ বন্ধুরে ভুলিয়ো না যেন।

দেবতা রাখুন সুখে আর কী কহিব।

[প্রস্থান

[প্রস্থান

সন্ন্যাসী।

আহা যেতে যেতে দোঁহে চায় ফিরে ফিরে,

অশ্রুজলে ভালো করে দেখিতে না পায়।

বিপুল জগৎ মাঝে দিগন্তের পানে

সখা ওর কোথা গেল, কে জানে কোথায়।

এ কী সংশয়ের দেশে রয়েছি আমরা

চোখের আড়ালে হেথা সবি অনিশ্চয়।

বারেক যে কাছ হতে দূরে চলে গেল,

হয়তো সে কাছে ফিরে আর আসিবে না।

তাই সদা চোখে চোখে রেখে দিতে চাই,

তাই সদা টেনে নিই বুকের মাঝেতে।

কোথা কে অদৃশ্য হয় চারি দিক হতে

যাহা কিছু বাকি থাকে ভয়ে তাহাদের

আরো যেন দৃঢ় করে ধরি জড়াইয়া।

সবাই চলিয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন দেশে

অসীম জগতে মোরা কে কোথায় থাকি,

মাঝে লোক-লোকান্তের ব্যবধান পড়ে।

তবু কি গলায় দিবি মোহের বন্ধন,

সুখ দুঃখ নিয়ে তবু করিব কি খেলা,

যে রবে না তবু তারে রাখিবারে চাস!

ওরে, আমি প্রতিদিন দেখিতেছি যেন,

কে আমারে অবিরত আনিতেছে টেনে।

প্রতিদিন যেন আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া

জগৎ-চক্রের মাঝে যেতেছি পড়িতে --

চারি দিকে জড়াইছে অশ্রুর বাঁধন,

প্রতিদিন কমিতেছে চরণের বল।

যাক্‌ ছিঁড়ে। গেল ছিঁড়ে। চল্‌ ছুটে চল্‌।

চল্‌ দূরে -- যত দূরে চলে রে চরণ।

কে ও আসে অশ্রুনেত্রে শূন্য গুহা মাঝে,

কে ও রে পশ্চাতে ডাকে পিতা পিতা বলে।

ছিঁড়ে ফেল্‌ ভেঙে ফেল্‌ চরণের বাধা --

হেথা হতে চল্‌ ছুটে আর দেরি নয়।
1...7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15...17