সন্ন্যাসী
গুহা
সন্ন্যাসী
কোথা দিন, কোথা রাত্রি, কোথা বর্ষ মাস।
অবিশ্রাম কালস্রোতে কোথায় বহিছে
সৃষ্টি যেথা ভাসিতেছে তৃণপুঞ্জসম।
আঁধারে গুহার মাঝে রয়েছি একাকী,
আপনাতে বসে আছি আপনি অটল।
অনাদি কালের রাত্রি সমাধি-মগনা
নিশ্বাস করিয়া রোধ পাশে বসে আছে।
শিলার ফাটল দিয়া বিন্দু বিন্দু করি
ঝরিয়া পড়িছে বারি আর্দ্র গুহাতলে।
স্তব্ধ শীতজলে পড়ি অন্ধকার মাঝে
প্রাচীন ভেকের দল রয়েছে ঘুমায়ে।
বাদুড় গুহায় পশি সুদূর হইতে
অমানিশীথের বার্তা আনিছে বহিয়া।
কখনো বা কোনো দিন কে জানে কেমনে
একটি আলোর রেখা কোথা হতে আসে,
দিবসের গুপ্তচর রজনীর মাঝে
একটুকু উঁকি মেরে যায় পলাইয়া।
বসে বসে প্রলয়ের মন্ত্র পড়িতেছি,
তিল তিল জগতেরে ধ্বংস করিতেছি,
সাধনা হয়েছে সিদ্ধ, কী আনন্দ আজি।
জগৎ-কুয়াশা মাঝে ছিনু মগ্ন হয়ে,
অদৃশ্যে আঁধারে বসি সুতীক্ষ্ণ কিরণে
ছিঁড়িয়া ফেলেছি সেই মায়া-আবরণ,
জগৎ চরণতলে গিয়াছে মিলায়ে--
সহসা প্রকাশ পাই দীপ্ত মহিমায়।
বসে বসে চন্দ্র সূর্য দিয়েছি নিবায়ে,
একে একে ভাঙিয়াছি বিশ্বের সীমানা,
দৃশ্য শব্দ স্বাদ গন্ধ গিয়েছে ছুটিয়া,
গেছে ভেঙে আশা ভয় মায়ার কুহক।
কোটি কোটি যুগব্যাপী সাধনার পরে,
যুগান্তের অবসানে, প্রলয়-সলিলে
সৃষ্টির মলিন রেখা মুছি শূন্য হতে--
ছায়াহীন নিষ্কলঙ্ক অনন্ত পুরিয়া
যে আনন্দে মহাদেব করেন বিরাজ,
পেয়েছি পেয়েছি সেই আনন্দ-আভাস।
জগতের মহাশিলা বক্ষে চাপাইয়া
কে আমারে কারাগারে করেছিল রোধ,
পলে পলে যুঝি যুঝি তিল তিল করি
জগদ্দল সে পাষাণ ফেলেছি সরায়ে,
হৃদয় হয়েছে লঘু স্বাধীন স্ববশ।
কী কষ্ট না দিয়েছিস রাক্ষসী প্রকৃতি
অসহায় ছিনু যবে তোর মায়াফাঁদে।
আমার হৃদয়-রাজ্যে করিয়া প্রবেশ
আমারি হৃদয় তুই করিলি বিদ্রোহী।
বিরাম বিশ্রাম নাই দিবস-রজনী
সংগ্রাম বহিয়া বক্ষে বেড়াতেম ভ্রমি।
কানেতে বাজিত সদা প্রাণের বিলাপ,
হৃদয়ের রক্তপাতে বিশ্ব রক্তময়,
রাঙা হয়ে উঠেছিল দিবসের আঁখি।
বাসনার বহ্নিময় কশাঘাতে হায়
পথে পথে ছুটিয়াছি পাগলের মতো।
নিজের ছায়ারে নিজ বক্ষে ধরিবারে
দিনরাত্রি করিয়াছি নিষ্ফল প্রয়াস।
সুখের বিদ্যুৎ দিয়া করিয়া আঘাত
দুঃখের ঘনান্ধকারে দেছিস ফেলিয়া।
বাসনারে ডেকে এনে প্রলোভন দিয়ে
নিয়ে গিয়েছিস মহা দুর্ভিক্ষ মাঝারে।
খাদ্য বলে যাহা চায় ধূলিমুষ্টি হয়।
তৃষ্ঞার সলিলরাশি যায় বাষ্প হয়ে।
প্রতিজ্ঞা করিনু শেষে মন্ত্রণায় জ্বলি
এক দিন -- এক দিন নেব প্রতিশোধ।
সেই দিন হতে পশি গুহার মাঝারে
সাধিয়াছি মহা হত্যা আঁধারে বসিয়া।
আজ সে প্রতিজ্ঞা মোর হয়েছে সফল।
বধ করিয়াছি তোর স্নেহের সন্তানে,
বিশ্ব ভস্ম হয়ে গেছে জ্ঞানচিতানলে।
সেই ভস্মমুষ্টি আজ মাখিয়া শরীরে
গুহার আঁধার হতে হইব বাহির।
তোরি রঙ্গভূমিমাঝে বেড়াব গাহিয়া
অপার আনন্দময় প্রতিশোধ-গান।
দেখাব হৃদয় খুলে, কহিব তোমারে,
এই দেখ্ তোর রাজ্য মরুভূমি আজি,
তোর যারা দাস ছিল স্নেহ প্রেম দয়া
শ্মশানে পড়িয়া আছে তাদের কঙ্কাল,
প্রলয়ের রাজধানী বসেছে হেথায়।