বালিকার ভগ্নকুটির
পথপার্শ্বে
বালিকার ভগ্নকুটির
বালিকা।
পিতা।
সন্ন্যাসী।
আহা পিতা বলে কে ডাকিলি ওরে।
সহসা শুনিয়া যেন চমকি উঠিনু।
বালিকা।
কী শিক্ষা দিতেছ প্রভু বুঝিতে পারি নে।
শুধু বলে দাও মোরে আশ্রয় কোথায়।
কে আমারে ডেকে নেবে, কাছে করে নেবে,
মুখ তুলে মুখপানে কে চাহিবে মোর।
সন্ন্যাসী।
আশ্রয় কোথায় পাবি এ সংসারমাঝে।
এ জগৎ অন্ধকারে প্রকাণ্ড গহ্বর--
আশ্রয় আশ্রয় বলে শত লক্ষ প্রাণী
বিকট গ্রাসের মাঝে ধেয়ে পড়ে গিয়া
বিশাল জঠরকুণ্ডে কোথা পায় লোপ।
মিথ্যা রাক্ষসীরা মিলে বাঁধিয়াছে হাট,
মধুর দুর্ভিক্ষরাশি রেখেছে সাজায়ে,
তাই চারি দিক হতে আসিছে অতিথি
যত খায় ক্ষুধা জ্বলে, বাড়ে অভিলাষ,
অবশেষে সাধ যায় রাক্ষসের মতো
জগৎ মুঠায় করে মুখেতে পুরিতে।
হেথা হতে চলে আয় -- চলে আয় তোরা।
বালিকা।
এখানে তো সকলেই সুখে আছে পিতা।
দূরেতে দাঁড়িয়ে আমি চেয়ে চেয়ে দেখি!
সন্ন্যাসী।
হায় হায় ইহাদের বুঝাব কেমনে।
সুখ দুঃখ সে তো বাছা জগতের পীড়া।
জগৎ জীবন্ত মৃত্যু -- অনন্ত যন্ত্রণা;
মরণ মরিতে চায় মরিছে না তবু
চিরদিন মৃত্যুরূপে রয়েছে বাঁচিয়া।
জগৎ মৃত্যুর নদী চিরকাল ধরে
পড়িছে সমুদ্রমাঝে ফুরায় না তবু --
প্রতি ঢেউ, প্রতি তৃণ, প্রতি জলকণা
কিছুই থাকে না, তবু সে থাকে সমান।
বিশ্ব মহা মৃতদেহ তারি কীট তোরা
মরণেরে খেয়ে খেয়ে রয়েছিস বেঁচে,
দু-দণ্ড ফুরায়ে যাবে কিলিবিলি করি
আবার মৃতের মাঝে রহিবি মরিয়া।
বালিকা।
কী কথা বলিছ পিতা ভয় হয় শুনে।
পথে এক জন ভিক্ষুক পথিকের প্রবেশ
পথে এক জন ভিক্ষুক পথিকের প্রবেশ
পথিক।
আশ্রয় কোথায় পাব? আশ্রয় কোথায়?
সন্ন্যাসী।
আশ্রয় কোথাও নাই -- কে চাহে আশ্রয়?
আশ্রয় কেবল আছে আপনার মাঝে।
আমি ছাড়া যাহা কিছু সকলি সংশয়।
আপনারে খুঁজে লও ধরো তারে বুকে,
নহিলে ডুবিতে হবে সংশয়-পাথারে।
পথিক।
আশ্রয় কে দেবে মোরে? আশ্রয় কোথায়?
বালিকা।
(বাহিরে আসিয়া)
আহা, কে গো, আসিবে কি এ মোর কুটিরে?
কাল প্রাতে চলে যেয়ো শ্রান্তি দূর করে।
একপাশে পর্ণশয্যা রেখেছি বিছায়ে,
এনে দেব ফলমূল নির্ঝরের জল।
পথিক।
কে তুমি গো?
বালিকা।
তোমাদেরি এক জন আমি।
পথিক।
পিতার কী নাম তব? কে তুমি বালিকা?
বালিকা।
পরিচয় না পেলে কি আসিবে না ঘরে?
তবে শুন পরিচয় -- রঘু পিতা মম,
অনার্যা অশুচি আমি, বিশ্বের ঘৃণিত।
পথিক।
(চমকিয়া) রঘুর দুহিতা তুমি? সুখে থাকো বাছা।
কাজ আছে অন্যত্তরে, ত্বরা যেতে হবে।
একটা খাট মাথায় হাসিতে হাসিতে পথে
এক দল লোকের প্রবেশ
একটা খাট মাথায় হাসিতে হাসিতে পথে
এক দল লোকের প্রবেশ
সকলে মিলিয়া।
হরিবোল--হরিবোল।
প্রথম।
বেটা এখনো জাগল না রে।
দ্বিতীয়।
বিষম ভারি।
এক জন পথিক।
কে হে, কাকে নিয়ে যাও।
তৃতীয়।
বিন্দে তাঁতি মড়ার মতো ঘুমোচ্ছিল, বেটাকে খাটসুদ্ধ উঠিয়ে এনেছি।
সকলে।
হরিবোল -- হরিবোল।
দ্বিতীয়।
আর ভাই বইতে পারি নে, একবার ঝাঁকা দাও, শালা জেগে উঠুক।
বিন্দে।
(সহসা জাগিয়া উঠিয়া) অ্যাঁ অ্যাঁ উঁ উঁ।
তৃতীয়।
ওরে, শব্দ করে কে রে।
বিন্দে।
ওগো, ওগো, এ কী। আমি কোথায় যাচ্ছি।
সকলে।
(খাট নামাইয়া) চুপ কর্ বেটা।
দ্বিতীয়।
শালা মরে গিয়েও কথা কয়।
চতুর্থ।
তুই যে মরেছিস রে! হাত-পাগুলো সিধে করে চিত হয়ে পড়ে থাক্।
বিন্দে।
আমি মরি নি, আমি ঘুমোচ্ছিলুম।
পঞ্চম।
মরেছিস তোর হুঁশ নেই, তুই তর্ক করতে বসলি! এমনি বেটার বুদ্ধি বটে।
ষষ্ঠ।
ওর কথা শোন কেন! বিপদে পড়ে এখন মিথ্যে কথা বলছে।
সপ্তম।
মিছে দেরি কর কেন? ও কি আর কবুল করবে? চলো ওকে পুড়িয়ে নিয়ে আসি গে।
বিন্দে।
দোহাই বাবা, আমি মরি নি। তোদের পায়ে পড়ি বাবা, আমি মরি নি।
প্রথম।
আচ্ছা, আগে প্রমাণ কর্ তুই মরিস নি।
বিন্দে।
হাঁ, আমি প্রমাণ করে দেব, আমার স্ত্রীর হাতে শাঁখা আছে দেখবে চলো।
দ্বিতীয়।
না, তা না, ওকে মার্, দেখি ওর লাগে কি না।
তৃতীয়।
(মারিয়া) লাগছে?
বিন্দে।
উঃ!
চতুর্থ।
এটা কেমন লাগল?
বিন্দে।
ও বাবা!
পঞ্চম।
এটা কেমন?
বিন্দে।
তুমি আমার ধর্মবাপ।
[সহসা ছুটিয়া পলায়ন ও হাসিতে হাসিতে সকলের অনুগমন
সন্ন্যাসী।
আহা শ্রান্তদেহে বালা ঘুমিয়ে পড়েছে।
ভুলে গেছে সংসারের অনাদর-জ্বালা।
কঠিন মাটিতে শুয়ে শিরে হাত দিয়ে
ঘুমের মায়ের কোলে রয়েছে আরামে।
যেন এই বালিকার ছোটো হাত দুটি
হৃদয়েরে অতি ধীর করিছে বেষ্টন।
পালা, পালা এইবেলা, পালা এইবেলা।
ঘুমিয়েছে, এইবেলা ওঠ্ রে সন্ন্যাসী।
পলায়ন! পলায়ন! ছি ছি পলায়ন!
অবহেলা করি আমি বিশ্বজগতেরে
বালিকা দেখিয়া শেষে পলাইতে হবে!
কখনো না, পালাব না, রহিব এমনি।
প্রকৃতি, এই কি তোর মায়াফাঁদ যত!
এ উর্ণাজালে তো শুধু পতঙ্গেরা পড়ে।
বালিকা।
(চমকিয়া জাগিয়া)
প্রভু চলে গেছ তুমি! গেছ কি ফেলিয়া!
সন্ন্যাসী।
কেন যাব! কার ভয়ে পলাইব আমি!
ছায়ার মতন তোরে রাখিব কাছেতে,
তবুও রহিব আমি দূর হতে দূরে।
বালিকা।
ওই শোনো, রাজপথে মহা কোলাহল।
সন্ন্যাসী।
কোলাহল মাঝে আমি রচিব নির্জন,
নগরে পথের মাঝে তপোবন মোর,
পাতিব প্রলয়াসন সৃষ্টির হৃদয়ে।
একদল পুরুষ ও স্ত্রীলোকের প্রবেশ
একদল পুরুষ ও স্ত্রীলোকের প্রবেশ
প্রথমা স্ত্রী।
(কোনো পুরুষের প্রতি) যাও, যাও, আর মুখের ভালোবাসা দেখাতে হবে না।
প্রথম পুরুষ।
কেন, কী অপরাধ করলুম?
স্ত্রী।
জানি গো জানি, তোমরা পুরুষমানুষ, তোমাদের পাষাণ প্রাণ।
প্রথম পুরুষ।
আচ্ছা, আমাদের পাষাণ প্রাণই যদি হবে, তবে ফুলশরকে কেন ডরাই? (অন্য সকলের প্রতি) কী বল ভাই। যদি পাষাণই হবে তবে কি আর ফুলশরের আঁচড় লাগে!
দ্বিতীয় পুরুষ।
বাহবা, বেশ বলেছ।
তৃতীয় পুরুষ।
শাবাশ, খুড়ো, শাবাশ।
চতুর্থ পুরুষ।
(স্ত্রীলোকের প্রতি) কেমন! এখন জবাব দাও!
প্রথম পুরুষ।
না, তাই বলছি। তোমরা তো দশ জন আছ, তোমরাই বিচার করে বল না কেন, যদি পাষাণ প্রাণই হবে,তবে --
পঞ্চম পুরুষ।
ঠিক কথা বলেছ। তুমি না হলে আমাদের মুখরক্ষা করত কে।
ষষ্ঠ পুরুষ।
খুড়ো এক-একটা কথা বড়ো সরেস বলে।
সপ্তম পুরুষ।
হাঁঃ আমিও অমন বলতে পারতুম। ও কি আর নিজে বলে? কোন্ এক পুঁথি থেকে পড়ে বলছে।
অষ্টম পুরুষ।
(আসিয়া)। কী হে কী কথাটা হচ্ছে। কী কথাটা হচ্ছে।
প্রথম পুরুষ।
শোনো, তোমায় বুঝিয়ে বলি। এই উনি বলছিলেন, তোমরা পুরুষ মানুষ, তোমাদের পাষাণ প্রাণ। তাইতে আমি বললেম, আচ্ছা যদি পাষাণ প্রাণই হবে, তবে ফুলশরের আঁচড় লাগবে কী করে। বুঝেছ ভাবখানা! অর্থাৎ যদি --
অষ্টম পুরুষ।
আমাকে আর বোঝাতে হবে না দাদা। আমি আর বুঝি নি! আজ বাইশ বৎসর ধরে আমি নিজ শহরে গুড়ের কারবার করে আসছি আর একটা মানে বুঝতে পারব না, এ কোন্ কথা।
প্রথম পুরুষ।
(স্ত্রীলোকের প্রতি) কেমন, এখন একটা জবাব দাও।
সকল স্ত্রীলোক মিলিয়া গান
সকল স্ত্রীলোক মিলিয়া গান
কথা কোস নে লো রাই শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে।
কে জানে ও কেমন করে মন কেড়েছে।
শুধু ধীরে বাজায় বাঁশি, শুধু হাসে মধুর হাসি,
গোপিনীদের হৃদয় নিয়ে তবে ছেড়েছে।
একজন পুরুষের গান
একজন পুরুষের গান
প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে,
রাঙা চরণতলে নেচে নেচে।
ঢিপঢিপিয়ে যেতেম মারা, মাথা খুঁড়ে হতেম সারা,
কানের কাছে কচকচিয়ে মানটি তোমার নিতেম যেচে।
দ্বিতীয় পুরুষ।
বাহবা দাদা, বেশ গেয়েছ।
তৃতীয় পুরুষ।
বেশ, বেশ, সাবাশ।
সপ্তম পুরুষ।
আরে দূর, ওকে কি আর গান বলে। গাইত বটে নিতাই; যে হাঁ, শুনে চক্ষু দিয়ে অশ্রু পড়ত।
[প্রস্থান
[প্রস্থান